এ বছরের শুরুর দিকে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করে। এ আগ্রাসন মোকাবিলা করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অসাধারণ ঐক্য দেখা দিয়েছিল।
এ বছরের শুরুর দিকে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করে। এ আগ্রাসন মোকাবিলা করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অসাধারণ ঐক্য দেখা দিয়েছিল।

মতামত

জ্বালানিসংকটে ইউক্রেন নিয়ে বিভক্তি বাড়ছে ইউরোপে

এ মাসের শুরুর দিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও বলেছেন, ‘ইউরোপের ঐক্য এখন প্রধানতম উদ্বেগ। আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করাই রাশিয়ার পরিচালিত ইউক্রেন যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য।’ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের বিদায়ের পর মাখোঁ নিজেকে ইউরোপের শীর্ষ নেতা বলে মনে করছেন। বারবার করে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সংহতি ও সমন্বয়ের তাগিদ দিচ্ছেন। আবার ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও বজায় রাখার ওপরও জোর দিচ্ছেন। এ বছরের শুরুর দিকে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করে। এ আগ্রাসন মোকাবিলা করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অসাধারণ ঐক্য দেখা দিয়েছিল। জ্বালানি তেলকে কেন্দ্র করে এখন সেই ঐক্যে ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে।

এমানুয়েল মাখোঁও বাল্টিক অঞ্চল ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর নেতাদের ‘যুদ্ধ প্ররোচনাকারী’ হিসেবে চিত্রিত করে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছেন। আবার তিনি বলছেন, ‘আমাদের পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর’ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘একা পদক্ষেপ’ নেওয়া ঠিক হবে না। এদিকে জনতুষ্টিবাদী দলগুলো ইউরোপের রাজনীতিতে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলছে। এ মাসের শেষে ইতালিতে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে অতি ডানপন্থীদের জোট। ব্রাদার্স অব ইতালি দলের জর্জা মেলোনির নেতৃত্বে এ জোটে প্রধান দুই সহযোগী হলো নর্দার্ন লিগের মাতেও সালভানি ও ফোরজা ইতালির সিলভিও বার্লুসকোনি।

মূলধারার ভোটারদের মন জয় করতে মেলোনি ইউক্রেন সংকটকে প্রথাগতভাবেই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রধান জোটসঙ্গী এবং ইউরোপের জনতুষ্টিবাদী দলগুলো জ্বালানিসংকটের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, সেই প্রশ্ন তুলছে।

এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে অতি ডানপন্থী জোটের আসন্ন বিজয় ইউক্রেন ইস্যুতে ইতালির পররাষ্ট্রনীতির বদল ঘটাবে কি না। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে কতটা সহায়তা দেওয়া যাবে, বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইউরোপের জ্বালানি বাজার থেকে শুরু করে রাজনীতির ময়দান—সবখানেই গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ।

বাল্টিক ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ইউরোপে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থায় ছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ দেশগুলো মহাদেশের রাজনীতিতে জোরালো কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া যে বিপুল শক্তি নিয়ে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, সেই ধারণা এ দেশগুলো আগে থেকেই দিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের বড় দেশ ফ্রান্স শেষ মুহূর্তে এসেই বিষয়টি আঁচ করতে পারে। এ বছরের শুরুতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর মাখোঁ বরং বলেছিলেন, ইউক্রেনে বড় কোনো যুদ্ধে জড়াবে না রাশিয়া। মস্কো সফর শেষে মাখোঁ খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর তৎপরতা সম্পর্কে আমাকে নিশ্চিত করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে ইউরোপের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে না।’

যুদ্ধ শুরুর পর বাল্টিক ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনের জন্য অস্ত্রের জোগান দিয়েছে। কিয়েভে মানবিক ও সামরিক সহায়তা বাড়ানোর জন্য ইউরোপের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। মাথাপিছু আয় বিবেচনা করলে ইউক্রেনে সামরিক ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাল্টিক দেশ এস্তোনিয়া সবচেয়ে এগিয়ে। পরিমাণের দিক থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পোল্যান্ড সবচেয়ে এগিয়ে।

ইউক্রেনে পূর্ব ইউরোপের এই সহযোগিতা অত্যুক্তি নয়। গত মাসে পোল্যান্ড নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। প্রতিবেশী ইউক্রেনকে বড় পরিসরে সামরিক সহায়তা দেওয়ায় তাদের অস্ত্রাগারে টান পড়েছে। সরাসরি এসব সহায়তা ছাড়াও পূর্ব ইউরোপ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বড় ছাড় দিচ্ছে।

ইউরোপের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি ২৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি এস্তোনিয়ায়। এরপরও ক্রেমলিনের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জোর গলায় বলছে দেশটি। পোল্যান্ড রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য নিজেদের আইন সংশোধন করছে। মস্কোর প্রভাববলয়ে শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে থাকার পরও পূর্ব ইউরোপের এই দেশগুলো এখন মস্কোর ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার জন্য সুপারিশ করছে। এর মধ্যে রাশিয়ার নাগরিকেদের ভিসা প্রদান বন্ধের প্রসঙ্গও আছে। গত সপ্তাহে লাটভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডগার রিনকেভিকস ঘোষণা দেন, বাল্টিক দেশগুলো শেনজেন ভিসাধারী বাদে রাশিয়ার অন্য নাগরিকদের জন্য তাঁদের সীমান্ত প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করতে চলেছেন। গত সপ্তাহে আটটি বাল্টিক ও নর্ডিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকের একটি যৌথ চুক্তিতে পৌঁছাতে সম্মত হয়েছেন। রাশিয়ার নাগরিকদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে চান তাঁরা। তবে এ চুক্তি পাস হতে গেলে ব্রাসেলসে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়বে।

এর আগে মস্কো থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। এবারেও তিনি রাশিয়ার নাগরিকেদের ওপর পূর্ণমাত্রায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আরোপের বিরোধিতা করেছেন। এদিকে মাখোঁও মস্কোর সঙ্গে খোলাখুলি যোগাযোগ বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। এ মাসের শুরুর দিকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই যে কারও সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা চালিয়ে যেতে হবে, বিশেষ করে যারা আমাদের সঙ্গে একমত নয়।’ রাশিয়া ফ্রান্সে গ্যাস দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পরদিন মাখোঁ এ বক্তব্য দেন।

রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউরোপজুড়ে মূল্যস্ফীতির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বড় দেশগুলোতে বিশাল বিক্ষোভ হচ্ছে। ফলে ক্রেমলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জনতুষ্টিবাদী দলগুলো ইউরোপে তাদের ভিত্তি গড়ে তুলছে। ইতালিতে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে মারিও দ্রাগির নেতৃত্বে পরিচালিত মধ্যপন্থী জোট সরকারের পতন হয়। এখন মেলোনির নেতৃত্বে অতি ডানপন্থীদের জোট প্রতিদ্বন্দ্বী মধ্য বামপন্থীদের থেকে দ্বিগুণ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে।

মেলোনির জোটের দুই বড় অংশীদার সালভানি ও বার্লুসকোনি রাশিয়ার প্রতি ব্যাপকভাবে সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় অর্থনীতি ইতালিতে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। বড় ধরনের জ্বালানিসংকট সৃষ্টি হয়েছে। সালভানির রাজনৈতিক ভিত্তি উত্তর ইতালিতে। মস্কোর সঙ্গে ব্যবসার অবনতি ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে সেখানকার জনজীবনে বড় প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে বার্লুসকোনির সঙ্গে পুতিনের সুখপ্রদ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ডানপন্থীদের সঙ্গে মস্কোর কূটনৈতিকদের সম্পর্ক ও যোগাযোগের কারণে অনেকে অভিযোগ করেছেন, দ্রাগি সরকার পতনের পেছনে মস্কোর হাত রয়েছে। যদিও ডানপন্থী নেতারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে অতি ডানপন্থী জোটের আসন্ন বিজয় ইউক্রেন ইস্যুতে ইতালির পররাষ্ট্রনীতির বদল ঘটাবে কি না। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে কতটা সহায়তা দেওয়া যাবে, বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইউরোপের জ্বালানি বাজার থেকে শুরু করে রাজনীতির ময়দান—সবখানেই গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ।

রিচার্ড জাভাদ হেদারিয়ান, ম্যানিলাভিত্তিক কলাম লেখক ও শিক্ষাবিদ
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে