অভিমত

উচ্চশিক্ষিত বেকার কি দেশের জন্য বোঝা

কিছুদিন আগে প্রথম আলোর ‘স্বপ্ন নিয়ে’ পাতায় কিছু তরুণের সফলতার কাহিনি ছাপা হয়। কাহিনিগুলো অসংখ্য বেকার তরুণকে উৎসাহিত করবে, সন্দেহ নেই।

কেউ বিরিয়ানি রান্না করে পৌঁছে দিচ্ছেন, কেউ খাতা বানিয়ে বিক্রি করছেন, কেউ শিঙাড়া-চপের দোকান দিয়েছেন, কেউ ক্যাকটাস বিক্রি করছেন, আবার কেউ মাছ-মাংস কেটে–ধুয়ে রান্নার উপযোগী করে সরবরাহ করছেন। এসব তরুণ বলছেন, তাঁরা এ ধরনের কাজ করে আয় করছেন, আনন্দও পাচ্ছেন।

যাঁরা এসব কাজ করছেন, তাঁদের সবাই উচ্চশিক্ষিত। কারও কারও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ, কেউ কেউ এখনো পড়ছেন।

এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, যে ধরনের কাজ করে তাঁরা আয় করছেন, এর জন্য আদৌ উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে কি না। কারণ, বিরিয়ানি রান্না করে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই ভাষাবিজ্ঞানের জ্ঞান লাগে না। খাতা বানিয়ে বিক্রি করার জন্য সমাজতত্ত্বের জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। শিঙাড়া-চপের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী হওয়ার দরকার নেই। অথচ তাঁরা একেকজন এ রকম একেক বিষয়ের শিক্ষার্থী। তাঁদের অনেকে পেশা হিসেবে বাকি জীবন এসব কাজই করে যাবেন।

দুই দশক আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন। তবে সেগুলো প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছিল খণ্ডকালীন। থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য তাঁরা সেগুলো করতেন। পাস করে চাকরি পাওয়ার পর এসব কাজ তাঁরা ছেড়ে দিতেন।

এখনো তরুণদের কেউ কেউ খণ্ডকালীন কাজ করেন, তবে বেশির ভাগের আগ্রহ তৈরি হয়েছে এমন কাজের দিকে, যেটি তাঁরা ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। তাঁদের অধিকাংশের লক্ষ্য অল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করা এবং ধীরে ধীরে সেই ব্যবসা বড় করা।

নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরু করার পেছনে অনেক বাস্তব কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ, চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এখন স্নাতক-স্নাতকোত্তর বা সমমানের পরীক্ষা পাস করেও প্রচুরসংখ্যক তরুণকে কর্মহীন হয়ে বসে থাকতে হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণের ১২ শতাংশের বেশি বেকার। আর যাঁরা কাজে যোগ দেন, তাঁদের বেশির ভাগই আশানুরূপ বেতন পান না, কিংবা কম আয় করেন। এটা এতই কম যে সেই টাকা দিয়ে জীবনযাপনের ন্যূনতম চাহিদাটুকু পূরণ করতে হিমশিম খেতে হয়।

আগে দরিদ্র পরিবারের মা-বাবাও সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য খরচ করতেন। কারণ, তাঁরা জানতেন, পাস করলে তাঁদের ছেলে বা মেয়ে কোনো না কোনো কাজে যুক্ত হতে পারবেন। কিন্তু এখনকার দিনে চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তার কারণে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পরিবার থেকে চাহিদামতো অর্থসহায়তা নিতে পারেন না।

তরুণদের অভিযোগ, এত কষ্ট স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার পরও তাঁদের দুঃখ শেষ হয় না। কারণ, সব চাকরিতে তাঁরা আবেদন করতে পারেন না। নিয়োগকর্তারা অভিজ্ঞতার শর্ত দিয়ে বাধা তৈরি করেন। এ ব্যাপারে নিয়োগকর্তাদের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁরা বলেন, কাজের সঙ্গে মিল রেখে যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া যায় না। এ কারণে চাকরির বিজ্ঞাপনে অভিজ্ঞতার শর্ত দিতেই হয়।

এটা ঠিক, সরকারি-বেসরকারি কাজে যে ধরনের পেশাগত দক্ষতার দরকার হয়, একাডেমিক পড়াশোনার মধ্য দিয়ে তার পুরোটা পূরণ হবে না। আবার এটাও ঠিক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র হয়ে থাকছে। বাস্তব ক্ষেত্রে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করার মতো সক্ষমতা শিক্ষার্থীরা অর্জন করেন না। এ কারণে বাংলায় পাস করেও একজন চাকরিপ্রার্থী ঠিকমতো বাংলা লিখতে পারেন না। ভাষা-সম্পাদনার কাজেও তাঁর সাধারণ দক্ষতা তৈরি হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিষয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদেরও এ রকম বিষয়গত প্রয়োগ-দক্ষতার মারাত্মক ঘাটতি দেখা যায়। এর মূল কারণ, বিভাগগুলো সিলেবাস তৈরি করছে কোনো রকম শিক্ষাক্রম ছাড়াই। ফলে পাঠের লক্ষ্য প্রায় ক্ষেত্রেই নির্ধারিত নয়, কিংবা অস্পষ্ট।

পেশাগত উৎকর্ষের জন্য জ্ঞানকে নতুনভাবে উৎপাদন করতে পারার দক্ষতা জরুরি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানের রূপান্তর ঘটতে থাকে। একজন বিশেষজ্ঞ এই রূপান্তরকে বিবেচনায় নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে তাকে নতুন করে প্রয়োগ করতে পারেন। তাই বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার প্রথম ভিত্তি উচ্চশিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগও দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা অতি সীমিত আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অনেক ব্যয়বহুল। এর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বছর বছর সেশন ফি ও অন্যান্য ফি বাড়িয়ে চলেছে। আবার চাকরির বাজারে সবচেয়ে চাহিদা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক বছর ধরে এক হাজার করে শিক্ষার্থী কম ভর্তি করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বেকারত্ব কমিয়ে আনার জন্য আসন কমানোর বিকল্প নেই। এখন এই একই যুক্তিতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও যদি ভর্তির সময় আসনসংখ্যা কমায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কমালে পাস করা উচ্চশিক্ষিত বেকার কিছু কমতে পারে বটে, কিন্তু তাতে দেশের মোট বেকারের সংখ্যা কমবে না; বরং উচ্চশিক্ষার অভাবে তরুণদের জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা আরও হ্রাস পাবে। তাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ কমানো বিবেচ্য হতে পারে না। বরং ভাবতে হবে কর্মের সুযোগ ও পরিসর বাড়ানোর উপায় নিয়ে। উচ্চশিক্ষিত তরুণ—সে বেকারই হোক আর কর্মজীবীই হোক, দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখেন। এই এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিকও।

শিক্ষার সঙ্গে পেশার যথাযথ সমন্বয়ও দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বলেন, তাঁরা যে ধরনের কাজ করতে চান, সেটি তাঁদের পড়াশোনার সঙ্গে মেলে না। এমনকি তাঁরা পড়তে চান না, এমন বিষয়েও তাঁদের বাধ্য হয়ে ভর্তি হতে হয়। এর কারণে এসব শিক্ষার্থী শুরু থেকেই একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবার আর্থিক সংকটে থাকা দরিদ্র শিক্ষার্থীরা বাধ্য হন কাজের খোঁজ করতে কিংবা খুচরা কাজ করে আয়ের পথ বেছে নিতে। তাঁরাও ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের এই দুই ধরনের সংকট দূর করার উপায় নিয়েও ভাবতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ভর্তির আবেদনের সময়ই বিষয় পছন্দ করার সুযোগ রাখা যায়। সম্ভব হলে বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। আর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে, পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তী কর্মজীবনে তাঁরা সেই ঋণ শোধ করবেন।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক