বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০-এর শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। এ সেলফি প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সমীকরণ কী, এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে।
এর আগে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দুই মার্কিন কংগ্রেস সদস্য রিপাবলিকান দলের রিচ ম্যাককরমিক ও ডেমোক্রেটিক দলের এড কেইস বাংলাদেশ সফরে আসেন। সফরকালে তাঁরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে বাংলাদেশ ক্রমশ চীনের বলয়ে চলে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে, বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চাচ্ছে, সামনে যে নির্বাচন আসছে, তা যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং যেন জনমতের প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় সুষ্ঠু না হলে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যাঁরা দায়ী হবেন, তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ভিসা দেওয়া হবে না বলেও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে।
২০১৪ ও ২০১৮–এর দুটি নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অতটা আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। নির্বাচন দুটির একটি হয়েছিল যখন ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় ছিল, আর অপরটি হয়েছিল রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় থাকার সময়। তাহলে বর্তমান সময়ে এসে এমন কী ঘটল, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী করে তুলেছে? যুক্তরাষ্ট্র কি শুধুই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাচ্ছে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটলে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের দ্বারা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত হবে? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারলে এ সরকারের মাধ্যমেই তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে?
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলেও সামরিক-কৌশলগত অংশীদার নয়। সামরিক কৌশলগত অবস্থান থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের জায়গাটি ঠিক কোথায়? এটা কি নিছক আদর্শগত জায়গা থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মিশনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকেও সেই বিবেচনায় দেখা?
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলেও সামরিক-কৌশলগত অংশীদার নয়। সামরিক কৌশলগত অবস্থান থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের জায়গাটি ঠিক কোথায়? এটা কি নিছক আদর্শগত জায়গা থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মিশনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকেও সেই বিবেচনায় দেখা?
এ রকম বিবেচনা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের, অর্থাৎ সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্র ‘রপ্তানি’ বা তাদের ভাষায় ‘প্রতিষ্ঠা করা’ ছিল সে সময় তাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তারা বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জনও করেছিল। উন্নয়নশীল দুনিয়ার অনেকগুলো রাষ্ট্রে সোভিয়েত–সমর্থনে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছিল। এসব রাষ্ট্রে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপরীতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অনুসরণ করা হতো। এটাকে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন অর্থনীতি ঘোষণা দিয়ে একনায়ক শাসকেরা তাঁদের শাসনের বৈধতা দিয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মিশনে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোথাও সাফল্য লাভ করতে পারেনি।
৯/১১–পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে রেজিমের পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু দেশ দুটিতে পশ্চিমা মানদণ্ড অনুযায়ী গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ ছাড়া পরোক্ষ মার্কিন সমর্থন নিয়েও কোনো রাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মার্কিন মিশনের উদ্দেশ্য নিয়েও অনেকে, বিশেষত যাঁরা বাম ও ইসলামপন্থার রাজনীতি করেন, তাঁরা সন্দিহান। তাঁরা বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করেন ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য হিসেবেই এ ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। আবার দেখা গেছে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সেসব রাষ্ট্রকেই বেছে নেওয়া হয়, যাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হয় বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, অথবা যারা কৌশলগত বা নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়। যেমন ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে করে। ফলে এ রাষ্ট্র ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে সরব নয়।
এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কৌশলগত বা নির্ভরযোগ্য মিত্র—এর কোনোটাই মনে করে না। ফলে বড় দাগে যেসব রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার সম্মুখীন হয়, বাংলাদেশ সে ক্যাটাগরিতে পড়েছে। তদুপরি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হওয়ার কারণে এবং ধর্মীয়ভাবে যারা সংখ্যালঘু, তারা নানা বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে বাংলাদেশকে সমালোচনা করা সহজ হয়েছে।
এই নেতিবাচক উপাদানগুলো ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়ও বিরাজমান ছিল। সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ এবং সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও যুক্তরাষ্ট্র সে সময় নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে জোরেশোরে প্রশ্ন তোলেনি। এ প্রশ্ন না তোলার কারণ, তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গণচীনের ভূমিকা অতটা জোরালো হয়ে ওঠেনি। চীন ও রাশিয়াকে প্রধান শত্রু ধরে যুক্তরাষ্ট্র তখনো তাদের পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতি প্রণয়ন করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের তখন মূল লক্ষ্য ছিল বুশ জুনিয়র প্রবর্তিত ৯/১১–পরবর্তী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। ২০১৮ সালের দিকে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্র এ নীতি থেকে সরে এসে চীন ও রাশিয়াকেন্দ্রিক নীতি প্রণয়ন করে, যার ধারাবাহিকতা বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের সময়েও অব্যাহত রয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেন। এ সফরের পর থেকে বাংলাদেশ–চীন অর্থনৈতিক সম্পর্কে গতি পায়। বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয়। এ উদ্যোগে যোগ দেওয়ার পর বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এখন চীন। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলারের, অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে এর পরিমাণ যথাক্রমে ১০ ও ১৮ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, চীন ও ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বড় অংশটি হচ্ছে আমদানিনির্ভর।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতও সেই আশির দশক থেকেই বহুলাংশে গণচীননির্ভর। বর্তমানে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের ৭২ শতাংশের জোগানদাতা চীন। ২০১০ সাল থেকে, অর্থাৎ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ চীন থেকে ক্রয় করেছে ২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসামগ্রী। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে মাত্র ১২৩ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম।
চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি শুধু যে বাংলাদেশে বেড়েছে, এমনটি নয়। ২০ বছর ধরে চীন আস্তে আস্তে তার উপস্থিতি বাড়িয়েছে এশিয়া, আফ্রিকাসহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। এর পাশাপাশি সেসব দেশে বেড়েছে রাশিয়ার উপস্থিতিও। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও বাংলাদেশসহ এসব রাষ্ট্র অবকাঠামোগত বিনিয়োগ, উন্নয়নসহায়তা, ঋণ, অনুদানসহ প্রায় সবকিছুর জন্যই নির্ভরশীল ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার ওপর।
বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সোভিয়েত–উত্তর রাশিয়া ও গণচীনের ভূমিকা তখনো এত জোরালো হয়ে ওঠেনি। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এ দুটি দেশের ভূমিকা জোরালো হয়ে ওঠার পর উন্নয়নশীল বিশ্বের শাসকেরা নানা কারণে পশ্চিমের ওপর নির্ভরতা কমাতে উদ্যোগী হয়েছেন। এসব রাষ্ট্রের শাসক ও জনগণের মধ্যে দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পশ্চিমের মতো জীবনমানের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা জন্ম লাভ করেছে।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর তাদের অবকাঠামো উন্নয়নের পর্যাপ্ত সহায়তাদানে ব্যর্থতা বা অনীহা, উচ্চতর প্রযুক্তিনির্ভর (যেমন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি) অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা না করা, আর্থিক অনুদান ও ঋণের সঙ্গে নানাবিধ রাজনৈতিক-সামাজিক শর্তারোপ, উচ্চ হারে সুদ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে পরিচিত রাষ্ট্রের শাসকেরা চীন-রাশিয়াকে পশ্চিমা দুনিয়ার বিকল্প ভাবতে শুরু করেন। চীন-রাশিয়ার ভূমিকা তাঁদের পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দর-কষাকষিতে সাহায্যও করে।
পশ্চিমা দুনিয়া ও তাদের প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রমুখ মোটাদাগে যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক শর্ত জুড়ে দেয়, তার সবকিছু যে খারাপ, বিষয়টি এমন নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন, সুশাসন—এসব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় ঋণের সঙ্গে। কিন্তু উন্নয়নশীল বেশির ভাগ রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। অনেক রাষ্ট্রেই রয়েছে স্বৈরশাসন, একদলীয় শাসন, হাইব্রিড রেজিম ও সামরিক শাসন। ফলে এই শাসকদের কাছে পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনৈতিক প্রেসক্রিপশন অস্বস্তি তৈরি করে। তাঁদের কাছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাইরের হস্তক্ষেপমুক্ত ‘সার্বভৌম গণতন্ত্রের’ ধারণা অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়। কেননা, এ তত্ত্ব অনুযায়ী তাঁদের শাসনক্ষমতার বৈধতা বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে বাইরের বা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কোনো কিছু বলার অধিকার নেই।
ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ শিক্ষক, স্কুল অব সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজ, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র।