ডোনাল্ড ট্রাম্প কি দায়মুক্তি পাবেন

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা চলছে। ট্রাম্পের দাবি, আইন তাঁকে দায়মুক্তি দিয়েছে। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বিচার চলতে পারে না। মার্কিন সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ট্রাম্প দায়মুক্তি পেতে পারেন কি না, তা নিয়ে লিখেছেন ন্যান্সি আইজেনবার্গ

একজন পর্নো অভিনেত্রীর মুখ বন্ধ রাখার জন্য গোপনে ঘুষ দেওয়া এবং ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করার ফৌজদারি অভিযোগের মুখে পড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়মুক্তির সুবিধা তাঁর প্রাপ্য।

ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, আইন তাঁকে দায়মুক্তি দিয়েছে; তাই এসব অভিযোগে তাঁর বিচার চলতে পারে না। তাঁর এই দাবি ঠিক কি না, তা এখন সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করবেন।

সরকারপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথের দায়ের করা মামলায় তুলে ধরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও অন্তত তিনটি নজির থেকে যে বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি আমাদের সামনে আসছে, তা ট্রাম্পের দায়মুক্তির দাবিকে খারিজ করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুস্পষ্ট নজির হলো ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি মামলা। ওই মামলা একটি অভিশংসন তদন্তের দিকে মোড় নিয়েছিল এবং ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগ ত্বরান্বিত করেছিল।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা মামলার শুনানিতে স্মিথ যুক্তি দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি মামলায় পূর্বসূরিকে ক্ষমা করেছেন এবং এর অর্থ হলো নিক্সন যে অপরাধ করেছিলেন, তা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের দিক থেকে স্বীকার করে নেওয়া। আর নিক্সনের ক্ষমা কবুল তাঁর ‘অপরাধের স্বীকারোক্তি’রই প্রতিনিধিত্ব করেছে।

জেরাল্ড ফোর্ডের ক্ষমা না পেলে নিক্সন সম্ভবত ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি হতেন। একবার প্রেসিডেন্ট হলেই যদি নিরঙ্কুশ রক্ষাকবচ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত থাকার বিধান থাকত (ট্রাম্প যেমনটা দাবি করছেন), তাহলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ক্ষমা করার কোনো দরকারই পড়ত না।

জ্যাক স্মিথ যুক্তি দিয়েছেন, অন্য দুটি নজিরের সময়ের পার্থক্য দুই শতাব্দীর বেশি। একটি হলো, ১৮০৭ সালে প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আরোন বারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে হওয়া মামলা।

অন্য নজিরটি হলো, ২০২০ সালে ট্রাম্প বনাম ভ্যাঞ্চ মামলায় (পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের ব্যাংক হিসাবে ট্রাম্পের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছিল কি না, সেই বিষয়ক তদন্তের জন্য ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক বিবরণী পেশ করতে ২০১৯ সালে ম্যানহাটানের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি সাইরাস ভ্যাঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তবে ট্রাম্প সে হিসাব পেশ না করে সাইরাস ভ্যাঞ্চের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট এ ধরনের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্ত) সুপ্রিম কোর্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত।

আরোন বার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার প্রায় দুই বছর পর শুরু হওয়া বিচারে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল এই অভিযোগ আমলে নিয়েছিলেন যে বিবাদী আরোন বার আলাদা দেশ গঠনের জন্য পশ্চিমের অঙ্গরাজ্যগুলোয় বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে বারের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্প্যানিশ মেক্সিকোর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় মেক্সিকোর জমি দখলের জন্য একটি ফিলিবাস্টার (ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী) সংগঠিত করা। পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদপত্রগুলোর ছড়িয়ে দেওয়া গুজবের ওপর ভিত্তি করে সেই তথাকথিত ‘বার ষড়যন্ত্র’ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তবে সেই মামলায় শেষ পর্যন্ত বার খালাস পেয়ে যান।

তবে সর্বসাম্প্রতিক নজিরটি (ট্রাম্প বনাম ভ্যাঞ্চ মামলা) বারের মামলাটিকে নতুনভাবে আরও একবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ট্রাম্প বনাম ভ্যাঞ্চ মামলায় আদালত ট্রাম্পের হাজিরা এড়ানোর এবং পর্নো তারকাকে মুখ বন্ধ রাখার বিনিময়ে ঘুষ দেওয়ার (যে মামলাটি এখন নিউইয়র্কে বিচারাধীন) রেকর্ডপত্র নষ্ট করার সব চেষ্টাকে ভন্ডুল করেছেন।

এবার আসুন ঘটনাগুলোর দিকে একটু নজর বোলানো যাক।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সুপ্রিম কোর্ট চার বছর আগেই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়মুক্তির দাবিকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। বিশেষ কৌঁসুলি স্মিথের মতে, যুক্তরাষ্ট্র বনাম বার মামলা এবং ট্রাম্প বনাম ভ্যাঞ্চ মামলা হলো বর্তমান প্রসিকিউশনের ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক দলিল’। দুই দুটি মামলার প্রতিটিই নিশ্চিত করে, ‘প্রেসিডেন্টরাও বিচারিক প্রক্রিয়ার অধীন এবং কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’

ট্রাম্প বনাম ভ্যাঞ্চ মামলায় প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস সেই দুই শতাধিক বছর আগেকার আরোন বারের নজির টেনে অধিকাংশ মতামত দিয়েছেন। ১৮০৭ সালের বিচারের সময় প্রধান বিচারপতি মার্শাল একটি সাবপোনা ডুসেস টেকাম জারি করেছিলেন, যার অর্থ জেফারসনকে আদালতে কিছু কাগজপত্র হস্তান্তর করতে হবে এবং সম্ভবত তাঁকে আদালতে সশরীর হাজির হতে হবে। শেষ পর্যন্ত জন রবার্টস ট্রাম্প বনাম ভ্যাঞ্চ মামলার উপসংহারে বলেছেন, জেফারসনকে আইনের অধীন দেখানো হয়েছিল।

বারের মামলায় বিচারপতি মার্শালের যে উদ্ধৃতিটি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় সরকারপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি স্মিথের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে, সেটি হলো—‘প্রেসিডেন্ট জনগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত হন এবং যে সময়ের জন্য তিনি নির্বাচিত হন, তার মেয়াদ শেষ হলে তিনি আবার জনগণের কাতারে ফিরে যান।’

স্মিথ যুক্তি দিয়েছেন, একজন প্রেসিডেন্ট চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন। অর্থাৎ তিনি কোনো অবস্থাতেই একজন রাজার পদমর্যাদা ভোগ করেন না। একমাত্র রাজা দায়মুক্তির সুবিধা পেতে পারেন। স্মিথের যুক্তি, চার বছরের মেয়াদ ঠিক করে প্রেসিডেন্ট পদের পালাবদলের নীতি অনুসরণের মধ্যেই নির্বাহী ক্ষমতার সীমারেখা টেনে দেওয়া আছে।

এই নীতি নিশ্চিত করে, একজন প্রেসিডেন্ট কোনোভাবেই একজন রাজার (যিনি সব সময় জনগণের বাইরে ও জনগণ থেকে উঁচু স্তরের অবস্থানে থাকেন) মতো কেউ নন। শুধু রাজারাই পরম দায়মুক্তির দাবি করতে পারেন। ফলে এটি নিশ্চিত যে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ক্ষমতা ও পদবি একেবারেই অস্থায়ী।

সুপ্রিম কোর্টের সামনে আজকে যে বিষয়টি ফয়সালা হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে, তা আদতেই ইতিমধ্যে মীমাংসিত হয়ে যাওয়া একটি বিষয়। কারণ, প্রেসিডেন্টের পরম রক্ষাকবচ বলতে কিছু নেই। এটিই আমেরিকান গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। এর ব্যত্যয় হলে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষেরা ঘেন্নায় কবরেও পাশ ফিরে শোবেন!

এখানেই বারের সেই মামলার তাৎপর্যের শেষ নয়। বার যখন বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন না। আগেই তিনি গদি হারিয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট জেফারসন তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

১৮০০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসের স্থলাভিষিক্ত হতে জেফারসন ও বার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। এখনকার দিনে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে যেভাবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট—দুটি পদ থাকে এবং আলাদা করে এই দুই পদে ভোটাভুটি হয়, তখনকার দিনের সংবিধানে এমন বিধান ছিল না। সে সময় ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পেতেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হতেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়া প্রার্থী হতেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

এর আগে অ্যাডামসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জেফারসন ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। ভোটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী হিসেবে তিনি অ্যাডামসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছর কাজ করেছিলেন। ১৮০০ সালের নির্বাচনে জেফারসন ও বার সমানসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন। এই ফল দুজনকেই ‘প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট’ বানিয়ে দেয়। পরে প্রতিনিধি পরিষদের ভোটে জেফারসনের জন্য প্রেসিডেন্ট এবং বারের জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ নির্ধারিত হয়।

এরপর ১৮০৪ সালে মার্কিন সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী এনে এ সমস্যাটি দূর করা হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ঠিক ওই বছরই জেফারসন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারকে দ্বিতীয়বার না নিয়ে বারের জায়গায় নিউইয়র্কের গভর্নর জর্জ ক্লিনটনকে মনোনীত করেন। এর মধ্য দিয়েও আমরা জানতে পারি, সংবিধান কখনোই একজন প্রেসিডেন্ট কিংবা ভাইস প্রেসিডেন্টকে পরিপূর্ণ দায়মুক্তি দেয়নি বা দেয় না।

সংবিধানে যদি তাঁদের দায়মুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে তার মাধ্যমে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়া হবে, নির্বাহী ব্যবস্থা ‘নির্বাচিত রাজতন্ত্রের’ শামিল, যা দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের কেউই কস্মিনকালে অনুমোদন দেননি।

সুপ্রিম কোর্টের সহযোগী বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার আগে পেনসিলভানিয়ার বিচারপতির দায়িত্ব পালন করার সময় জেমস উইলসন একটি মন্তব্য করেছিলেন। উইলসনের সেই মন্তব্য উদ্ধৃত করে বিশেষ কৌঁসুলি স্মিথ বলেছেন, প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট তাঁর ব্যক্তিগত অপকর্মের জন্য ফৌজদারি বিচারের অধীন ছিলেন এবং আছেন। আর তিনি যদি তাঁর ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার করেন, তাহলে তিনি অভিশংসনের শিকার হবেন।

বারের বিচারকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হোক না কেন, এখান থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার; আর তা হলো, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। প্রেসিডেন্ট প্রায় হয়েই গিয়েছিলেন এমন একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তাঁর বিচার করা যেতে পারে—এ কথায় যাঁদের সায় আছে, তাঁদের যে কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে যে কোনো ব্যক্তি একবার প্রেসিডেন্ট হলেই তাঁকে আর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না।

ভ্যাঞ্চ মামলায় রবার্টস তাঁর মতামত দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মার্শালের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একজন রাজা ক্ষমতাধর হয়েই জন্মগ্রহণ করেন এবং রাজতন্ত্র অনুযায়ী, তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সব সময়ই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ও আইনের আওতাধীন মানুষ।’

সুপ্রিম কোর্টের সামনে আজকে যে বিষয়টি ফয়সালা হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে, তা আদতেই ইতিমধ্যে মীমাংসিত হয়ে যাওয়া একটি বিষয়। কারণ, প্রেসিডেন্টের পরম রক্ষাকবচ বলতে কিছু নেই। এটিই আমেরিকান গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। এর ব্যত্যয় হলে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষেরা ঘেন্নায় কবরেও পাশ ফিরে শোবেন!

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • ন্যান্সি আইজেনবার্গ লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক

  • অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ