দেশের তরুণ প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ এখন বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। অনেক জরিপে বিষয়টা উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই এখন বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। দেশে একটা প্রজন্ম এর মধ্যে গড়ে উঠেছে, যারা স্বপ্ন দেখছে বিদেশে পাড়ি জমানোর। দেশ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নানা অভিযোগ আছে।
রাস্তায় বের হলে সর্বক্ষণ চিন্তায় থাকতে হয় নিজের শরীর নিয়ে। কখন না কোনো ঢাকনাখোলা ম্যানহোলে পড়তে হয় কিংবা ভাঙা কোনো রাস্তায় হোঁচট খেতে হয়। অথবা আচমকা কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়, এসব যদি না–ও হয়, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কিছু একটা ওপর থেমে মাথায় পড়তে পারে। কিংবা নির্মাণাধীন আস্ত গার্ডারও কেড়ে নিতে পারে প্রাণ।
কেউ আবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত। একেক সময় একেক সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নানা অরাজকতা। শিক্ষকেরা কখনো ছাত্রীদের নিপীড়ন করছে। কখনো আবার ছাত্ররাজনীতির বলি হচ্ছে সাধারণ ছাত্রছাত্রী।
জিনিসপত্রের দাম এক রাতের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে। ডিম দিয়ে ভাত খেতেই কারও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেউ আবার অভিজাত এলাকায় দামি রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছে। সেখানেও শান্তি নেই! কখনো পুড়ে মরতে হচ্ছে। কখনো আবার আস্ত ভবন ধসে পড়ছে। এ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে যাবে, সেখানেও শান্তি নেই!
কেউ সামান্য খতনা করতে গিয়ে মরে যাচ্ছে। কেউ আবার ভুল চিকিৎসায় বেঘোরে মারা পড়ছে। এমন সিস্টেমে কে আর থাকতে চায়? তাই এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিশাল একটা অংশ হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে দেশ ছাড়তে চায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোই কি চূড়ান্ত সমাধান?
এমনটা আসলে ভাবার কোনো মানে হয় না। কারণ, নিজের মাতৃভূমির টান মানুষের মধ্যে থেকেই যায়। ২০ বছর বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে তেমনটাই জানান দিচ্ছে। বিদেশে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে সেই বাংলাদেশে। তা ছাড়া বিদেশে থাকা প্রায় সবাই নিজ মাতৃভূমিতে নিজ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য হলেও একটা সময় পরপর দেশে যান। অল্প সময়ের জন্য দেশে গেলেও কিন্তু সেই একই সিস্টেমের মধ্য দিয়েই তাদের যেতে হয়।
বিদেশে পাড়ি জমানোটাও আসলে সেই অর্থে চূড়ান্ত সমাধান নয়। এর চেয়ে বরং সবাই মিলে আমাদের দেশ ও সমাজব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যেখানে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে যে কেউ অন্য পাশ দিয়ে পানের পিক ফেলবে না। ম্যানহোলের গর্তে কিংবা ওপর থেকে কিছু একটা পড়ে মরতে হবে না।
এই যেমন বেইলি রোডের ঘটনায় কিন্তু মালয়েশিয়াপ্রবাসী মারা গেছেন। ইতালিফেরত এক ব্যক্তি দেশে এসেছিলেন পরিবারকেও নিয়ে যেতে। গোটা পরিবারসহ তিনিও মারা গেছেন সেই আগুনে।
এই তো সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, মায়ের লাশ দেখার জন্য দেশে ফিরেছিলেন এক ব্যক্তি। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে মাইক্রোবাসে করে বাড়িতে যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় মারা গেছেন তিনিসহ আরেক স্বজন। অর্থাৎ অল্প সময়ের জন্য দেশে গেলেও কিন্তু যে কাউকে সেই একই সিস্টেমের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। যেই সিস্টেমের কারণে তাঁরা একসময় দেশ ছেড়েছিলেন। মাতৃভূমিকে তো আর ভুলে থাকা যাবে না। তাই বিদেশে থাকলেও দেশে তো যেতেই হয়।
বিদেশে পাড়ি জমানোটাও আসলে সেই অর্থে চূড়ান্ত সমাধান নয়। এর চেয়ে বরং সবাই মিলে আমাদের দেশ ও সমাজব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যেখানে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে যে কেউ অন্য পাশ দিয়ে পানের পিক ফেলবে না। ম্যানহোলের গর্তে কিংবা ওপর থেকে কিছু একটা পড়ে মরতে হবে না।
রেস্তোরাঁয় খাওয়ার সময় আগুনে পুড়ে কিংবা গার্ডার পড়ে বেঘোরে প্রাণ যাবে না। অথবা পরের বেলা খাবার পাব কি না, সেই চিন্তা করতে হবে না। স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মনে হবে না—এ কোথায় এলাম পড়তে!
দেশ ও দেশের বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিদেশে পাড়ি জমিয়ে যেমন চূড়ান্ত সমাধান সম্ভব নয়, তেমনি একটা দেশের তরুণ প্রজন্মের মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো বিদেশে পাড়ি জমালে সেই দেশের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সেটাও চিন্তা করতে হবে।
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo.com