বইপড়ায় লাস্ট, ফেসবুক করায় ফার্স্ট

পৃথিবীতে কোন দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি বই পড়ে? সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের জরিপে এসেছে, সবচেয়ে বেশি বই পড়ে আমেরিকানরা। গড়ে বছরে একজন আমেরিকান বই পড়ে ১৭টা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে ভারতীয়রা। একজন ভারতীয় বছরে গড়ে পড়ে ১৬টা বই। এরপরের স্থান যুক্তরাজ্যের।

আর বাংলাদেশের অবস্থান ৯৭। একজন বাংলাদেশি প্রতিবছর গড়ে বই পড়ে ২.৭৫টা। আমাদের পেছনে আছে অল্প কটা দেশই—আরব আমিরাত, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ব্রুনেই আর আফগানিস্তান।

আমার নিজের ধারণা, বাংলাদেশিরা জরিপের সময় চক্ষুলজ্জায় বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছিল। তা না হলে বছরে ২.৭৫টা বই পড়ার মতো বাংলাদেশি আশপাশে খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল।

আগের দিনে তবুও হয়তো লেখাপড়া-জানা মানুষেরা বই পড়তেন, কিন্তু ফেসবুক আসার পর বাঙালির হাতে সময় কই যে তারা বই পড়বে। গড়ে ২.৭৫টা বই হলে বছরে ১৬ কোটি মানুষ ৪৪ কোটি বই পড়ে ফেলত।

আপনারা যে যা-ই বলেন না কেন, এই ফলটা আমার কাছে আমাদের নির্বাচনের ফলের মতোই রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে!

হতে পারে, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই আর চাকরিপ্রার্থীদের গাইড বই এই হিসাবের মধ্যে ধরা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গড়ে ২.৭৫টা বই প্রতিবছর পড়া হয়ে থাকতেও পারে। তবু শিক্ষার্থীরাও আর পাঠ্যপুস্তক খোলে কি না, আমার সন্দেহ আছে। তারাও সরাসরি চলে যায় গাইড বইয়ে। ওইখানে পরীক্ষা পাসের উপায় ‘পুরিয়া’ বানিয়ে রাখা হয়েছে।

কাগজের ভাঁজ খুলে সরাসরি গিলে নিলেই হয়ে যায়। আমাদের সময়ে বাংলা পরীক্ষার প্রথম প্রশ্নটা থাকত, অমুক কবিতার প্রথম দশটি চরণ মুখস্থ লিখো। ফলে আমাদের অন্তত পাঠ্যপুস্তকের কিছু কবিতা মুখস্থ করতে হতো। এখন সে বালাইও উঠে গেছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী সেই কোনকালে ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে বলে গেছেন:

‘আর কত বলব? বাঙালির কী চেতনা হবে?

‘তাও বুঝতুম, যদি বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ণা না থাকত। আমার বেদনাটা সেখানেই। বাঙালি যদি হটেনটট হতো, তবে কোনো দুঃখ ছিল না। এ রকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতে কোথাও দেখিনি। জ্ঞানতৃষ্ণা তার প্রবল, কিন্তু বই কেনার বেলা সে অবলা।

আবার কোনো কোনো বেশরম বলে, “বাঙালির পয়সার অভাব।” বটে? কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা এ-কথা? ফুটবল মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, না সিনেমার টিকিট কাটার “কিউ” থেকে?

‘থাক থাক। আমাকে খামোখা চটাবেন না।’

এখনো কিছু লোক বলে, বইয়ের দাম বেশি বলে আমরা বই পড়ি না। কোথায় দাঁড়িয়ে আপনি কথাটা বলছেন, শাহরুখ খানের কনসার্ট দেখতে ৩৫ হাজার টাকার টিকেটের লাইনে দাঁড়িয়ে, নাকি কোরবানির হাটে ১৫ লাখ টাকার ছাগলের দড়ি হাতে নিয়ে!

বইয়ের দাম নাহয় সত্যই বেশি, কিন্তু আপনার শহরের লাইব্রেরিটায় তো বিনা পয়সায় বই পাওয়া যায়। কজন বাঙালি যান সেখানে? সারা বাংলাদেশের সব পাঠাগার থেকে অভিন্ন প্রতিবেদন আসে, কেউ আসে না, বই পড়ে না, যদিও-বা কোনো প্রৌঢ় বিকালবেলায় আসেন, তিনি পত্রিকা পড়েন। আর আসেন চাকরিপ্রার্থীরা, তাঁরা পত্রিকা থেকে চাকরির বিজ্ঞাপন টুকে নেন, অথবা সাধারণ জ্ঞানের জন্য আন্তর্জাতিক পাতাটা মন দিয়ে পড়েন।

শাহবাগের জাতীয় গণগ্রন্থাগারে একই দৃশ্য, বিসিএস পরীক্ষার্থীরা সকালবেলা এসে জায়গা দখল করে, তারা মন দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারও জমজমাট থাকে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের একান্ত অধ্যবসায়ের দ্বারা।

কাজেই জরিপকারীরা যদি নোটবই, গাইড বইকে বই হিসেবে ধরে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে বছরে ২.৭৫টা বই পড়ে থাকে, এই হিসাব সঠিক হলে হতেও পারে।

এই বিষয়ে আমি যে কৌতুকটা জানি, তা বলে নিই।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক ছাত্র তার এক সহপাঠিনীকে পছন্দ করে। অবশেষে একদিন সে মেয়েটিকে প্রস্তাব করে বসল। মেয়েটি কোনো জবাব দিল না। শুধু স্ট্রেংথ অব ম্যাটেরিয়ালস বইটা ছেলেটিকে উপহার দিল।

৩০ বছর পর ছেলেটি বুড়া হয়েছে। মেয়েটির কিশোরী থাকবার কোনো কারণ নেই। কলেজের পুনর্মিলনীতে দুজনের দেখা। এ গল্প ও গল্প। শেষে ছেলেটি বলল, ৩০ বছর আগে তোমাকে যে আমি প্রপোজ করেছিলাম, তুমি জবাব দাওনি কেন?

মেয়েটি বলল, জবাব দিইনি মানে! তোমাকে একটা এসএম বই দিয়েছিলাম, মনে নাই?
তা দিয়েছিলে।

বইটা খুলে দেখেছিলে?

মাথা খারাপ। আমি তো টেক্সট বই-ই পড়তাম না। নোটবই দিয়েই চালিয়ে দিতাম।

খোলোনি ভালোই করেছ—মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই বইয়ের ভেতরে একটা চিঠি দিয়েছিলাম।

অন্যদিকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ফেসবুকে থাকা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে। এই তালিকায় ভারতও আছে। আর আছে ফিলিপাইন।

তো ভারতীয়রা বইও পড়ে, ফেসবুকও করে, কাজেই তারা আসল স্মার্ট। আর আমরা বই পড়ি না, শুধু ফেসবুক করি, তার পরিণতি হলো সারা রাত জেগে থাকা, আর সারা দিন ঝিমানো, আর প্রতিটা কথায় ঝগড়া করা। আমরা হাঁটি না, সাঁতার কাটি না, দৌড়াই না, প্রার্থনা করি না, কারণ এই সব করলে ফেসবুক করব কখন! বৃষ্টি হচ্ছে, স্ট্যাটাস দিতে হবে সবার আগে, ভূমিকম্প হচ্ছে, লিখতে হবে ফেসবুকে, মা মারা যাচ্ছেন, দোয়া চাইতে হবে ফেসবুকে।

স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে পারি না, বই পড়ব কখন? ডেটা কিনতে সব পয়সা চলে যায়, বই কেনার টাকা আসবে কোত্থেকে! আমি তাই একটা নতুন স্লোগান ধরেছি। বই পড়তে হবে না। বই কিনুন। বই কিনে বইয়ের ছবি দিয়ে ফেসবুক পোস্ট দিন। আপনাকে স্মার্ট দেখা যাবে।

জানেন তো, সবচেয়ে সুন্দর মানুষ হলেন তিনি, যাঁর হাতে বই থাকে।

আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক