স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছরের পথপরিক্রমায় দ্বিতীয়বারের মতো দেশ একজন চিকিৎসককে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে। প্রায়ই বলা হয়, আইন মন্ত্রণালয়ে যেমন বরাবর একজন আইনজ্ঞকে মন্ত্রী করা হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তেমনি একজন চিকিৎসক বরাবর মন্ত্রী হওয়া সমীচীন। সেই সৌভাগ্য না হলেও দ্বিতীয়বার একজন চিকিৎসককে মন্ত্রী হিসেবে পাওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে।
কিন্তু অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন এমন সময় মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন, যখন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা অনাচারে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই অরক্ষিত। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র, হাসপাতাল তথা পুরো স্বাস্থ্য খাত আইনকানুন ও প্রাতিষ্ঠানিক শিকলে বন্দী। আর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ তো আছেই।
স্বাস্থ্যের নাজুক দশা কমাতে প্রয়োজন রাষ্ট্রের সব নীতিতে স্বাস্থ্যকে এক নম্বর গুরুত্বে রাখা, যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতার বাইরে। যেমন খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং প্লাষ্টিক দূষণের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যের নাজুক দশা দূর করতে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে। আবার পারস্পরিক রেষারেষি, হিংসা-বিদ্বেষ, বঞ্চনা-গঞ্জনা, হানাহানি, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে রাষ্ট্রকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ অবস্থায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবেন, তা নির্ভর করে তিনি স্বাস্থ্য খাতের অচলায়তন ভাঙতে কতটুকু সক্ষম হবেন। আমাদের প্রত্যাশার তালিকা অনেক বড়, তবে এখানে মোটাদাগে কিছু প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করা হলো।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে যত্রতত্রভাবে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ নানা ভুল নীতিতে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান আজ তলানিতে। সুন্নতে খতনা করতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যু এর একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র, যা মন্ত্রীকে দপ্তরে অভিষেকের দিনেই মুখোমুখী হতে হয়েছে। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অচিরেই চিকিৎসাসেবা আরও অনিরাপদ হয়ে যাবে। এ জন্য দ্রুত বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত কনিষ্ঠ থেকে মধ্যম সারির সব চিকিৎসককে ৬ থেকে ১২ মাসের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর খরচ কোনোভাবেই একটি বোয়িং বিমান কেনার খরচ থেকে বেশি হবে না। জাতিকে রক্ষা করতে রাষ্ট্রকে এ খরচ করতেই হবে।
দ্বিতীয়ত, পোস্টগ্র্যাজুয়েট, এমবিবিএস, নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টসহ মেডিকেল শিক্ষার সব ক্ষেত্রে গুণগত মানের উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।
এ জন্য মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উপযুক্ত শিক্ষক পদায়নসহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, আইএসটি, ম্যাটসসহ মেডিকেল শিক্ষার সব স্নাতক ও ডিপ্লোমাধারী প্রার্থীদের মেডিকেল লাইসেন্সিং (চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সনদ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণের ভিত্তিতে মেডিকেল প্র্যাকটিসের (চিকিৎসাসেবা প্রদান) অনুমতির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) শক্তিশালী করে শিগগির মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষা এবং তা নবায়নের পরীক্ষা চালু করতে হবে।
পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশে মেডিকেল স্নাতকদের জন্য লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু আছে। উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশে এর আধিক্য বেশি। এশিয়ার ২৩টির বেশি দেশে এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে মেডিকেল স্নাতকদের জন্য লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু আছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে কেবল চীন বা অন্য দেশ থেকে প্রাপ্ত মেডিকেল স্নাতকদের জন্য লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর, মেডিকেল শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন কীভাবে হবে, তা ভাবনায় আনা কঠিন; হয়তো একটি সুপার অধিদপ্তর গঠন করতে হবে, যার অধীন এসব অধিদপ্তর পরিচালিত হবে। আর দুই বিভাগের দুজন সচিবের পাশাপাশি একজন জ্যেষ্ঠ সচিবের পদ সৃষ্টি করে তাঁর অধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত হতে পারে।
তৃতীয়ত, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সেবা প্রদান হাসপাতাল বিবেচনার পরিবর্তে কেবল মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ হাসপাতাল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের মতো বেড সংখ্যার বেশি রোগী ভর্তির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। বরং জেলা হাসপাতালকে সেকেন্ডারি (মধ্যম পর্যায়) চিকিৎসার হাব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থত, সরকারি খাতের জন্য সাম্প্রতিক কালে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রণীত ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস স্ট্যান্ডার্ড (জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা মান) বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। আর নতুন নীতিমালা তৈরির ভিত্তিতে সম্পূর্ণ পথচ্যুত বেসরকারি খাতকে দ্রুত পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতকে পথে আনতে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য খাতের সব অঙ্গ সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার ব্যয়ের ভীতি দূর করে প্রদত্ত বরাদ্দ খরচে উৎসাহিত করতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রকিউরমেন্ট রুলস (সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইন) এবং অডিট (নিরীক্ষা) পদ্ধতি সহজ করতে হবে।
তবে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর, মেডিকেল শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন কীভাবে হবে, তা ভাবনায় আনা কঠিন; হয়তো একটি সুপার অধিদপ্তর গঠন করতে হবে, যার অধীন এসব অধিদপ্তর পরিচালিত হবে। আর দুই বিভাগের দুজন সচিবের পাশাপাশি একজন জ্যেষ্ঠ সচিবের পদ সৃষ্টি করে তাঁর অধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত হতে পারে।
আবার দুই বিভাগ পুনর্গঠন করে একটিকে প্রাইমারি (প্রাথমিক) স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, যার অধীন সারা দেশের প্রমোশনাল, প্রিভেন্টিভ, টিকাদান কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টিসেবাসহ ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতে পারে। অন্যটিকে মেডিকেল শিক্ষাসহ সেকেন্ডারি (মধ্যম পর্যায়) ও টারশিয়ারি (তৃতীয় পর্যায়) সেবার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, যার অধীন সব প্রকার মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সব ধরনের হাসপাতাল পরিচালিত হতে পারে।
ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে সব ধরনের ওষুধের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সূত্রের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত ‘মার্ক আপ’ (মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি) সংশোধন করে যৌক্তিকভাবে নতুন ‘মার্ক আপ’ নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সব ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স পরীক্ষা চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিশেষে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনে দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে একটি অনন্য স্বাস্থ্য আইডি প্রদান, হাসপাতাল অটোমেশন ব্যবস্থা (স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এমন ব্যবস্থা) চালু করা এবং সব নাগরিককে একই রকম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতিসহ যে ১০ দফা অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া।
আশা করি, মন্ত্রী এসব প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হবেন। তবে সময়ই বলে দেবে তিনি এসব প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু অগ্রগামী হবেন।
● ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক