মতামত

দূতাবাসে আশ্রিত নারীদের ধর্ষণ: এত সহজে পার পেয়ে যাবেন সেই উপসচিব?

বাংলাদেশ দূতাবাস অফিস, রিয়াদ, সৌদি আরব
ছবি: সংগৃহীত

রক্ষক যে কত বড় ভক্ষক হতে পারে, তার একটি সিল মারা উদাহরণ হতে পারেন মেহেদী হাসান। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। উপসচিব পর্যায়ে তিনি সৌদি দূতাবাসের কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি কী অপকর্ম করেছেন?

সৌদি আরবে নির্যাতিত প্রবাসী গৃহকর্মীদের জন্য রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি সেফ হোম খোলা হয়। সেখানে নির্যাতিত ও ভুক্তভোগীরা আশ্রয় ও সুরক্ষা পান। কিন্তু সেই সেফ হোম যেন তাঁদের জন্য আরেক নরকে পরিণত হয়েছিল এই মেহেদী হাসানের জন্য। তিনি সেসব নারীর জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন। দূতাবাসের কাউন্সিলর হিসেবে সেই নারীদের একান্ত সাক্ষাৎকারের নামে অপ্রয়োজনে ডেকে পাঠাতেন। বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতেন, এমনকি ধর্ষণও।

বিসিএস ২১তম ব্যাচের এই কর্মকর্তাকে স্থায়ীভাবে সরকারি চাকরি থেকে বহিষ্কার করেছে সরকার। ৬ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিষয়টি প্রকাশ করে। সেটি দেশের সব সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ পেয়েছে। সেদিনেরই প্রথম আলো অনলাইনের প্রতিবেদন, ‘সৌদি দূতাবাসে আশ্রিত নারীদের ধর্ষণে চাকরি গেল উপসচিবের’

মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ২০২০ সালে। একই বছর সংশ্লিষ্ট দূতাবাস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপর তাঁকে রিয়াদ থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। হন চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত। এত দিন তিনি ওএসডি ছিলেন। অবশেষে সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্তভাবে তাঁকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিধি অনুযায়ী গুরুদণ্ড হিসেবে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

তার মানে একজন ধর্ষকের গুরুদণ্ড শুধু চাকরিচ্যুতি! ধর্ষণের মতো বড় ফৌজদারি অপরাধের এ কেমন ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’?

সরকারি চাকরিরত ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ–সুবিধা পান এ দেশে। আর অনেকের ক্ষেত্রে উপরি ইনকামের কথা বললাম না। নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ করে পার পাওয়া যাবে, এটিও কি তাহলে এখন থেকে সরকারি চাকরির ‘সুবিধা’ হিসেবে যুক্ত হবে?

সুরক্ষা পেতে দূতাবাসের সেফ হোমে গিয়েও কি প্রবাসী নারী শ্রমিকদের রক্ষা আছে? সেখানে একজন মেহেদী হাসানের মতো ভক্ষকের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করে, তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্র ও সরকার কি তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করবে, নাকি এ রকম আরও সরকারি কর্মকর্তাকে মেহেদী হাসান হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে?

২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছে। তার আগপর্যন্ত সেটি ছিল যাবজ্জীবন। সেই আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ও শাস্তি নিশ্চিত করতে নানা ধারা-উপধারা আছে। সংসদে পাস হওয়া ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়া এই আইন তো রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্যই। জানি, মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে নানা আলোচনা আছে, সেটি ভিন্ন আলাপ। কিন্তু আইনটি কি তাহলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়? মেহেদী হাসানরা চাইলেই কি এভাবে ধর্ষণ করে যেতে পারবেন এবং ধর্ষণ করে পারও পেয়ে যাবেন? শাস্তি হিসেবে জুটবে শুধু চাকরি থেকে বহিষ্কার! এটি কীভাবে সম্ভব? একটি রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে এত বৈষম্য কীভাবে করতে পারে?

একটি সভ্য দেশে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে মামলা হয়, তাঁকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে, আদালতে শুনানির মধ্যেও তাঁকে যেতে হয়েছে। আর এ দেশে একজন চাকরিচ্যুত সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন তেমনটি হবে না? প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগে কখনো এ রকম কোনো মামলা করা হয়নি। কে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবে? তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের প্রমাণ কে করবে আদালতে?

কথা হচ্ছে, সরকার চাইলে পারে না, এমন কিছু নেই। এ দেশে রাজনৈতিকভাবে গায়েবি মামলা করে কত মানুষকে আসামি করা হয়েছে। মৃত মানুষের নামে গায়েবি মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে কবরস্থান পর্যন্ত চলে গেছে পুলিশ, এমন উদাহরণও আছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে ‘বড় সন্ত্রাসী’র মতো জেলে আটকে রাখা হয়েছে, বারবার জামিন স্থগিত রাখা হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে দুটি মামলা, সেগুলো তো পুলিশই করেছে। এ রকম অজস্র নমুনা আছে।

আর যেখানে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সরকারিভাবেই তদন্ত করে প্রমাণিত হয়েছে, সেখানে কেন তাঁর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলা হবে না? কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে না? জানি, ধর্ষণের মামলায় এমন কিছু প্রক্রিয়া আছে, যেখানে ভুক্তভোগীর জবানবন্দি প্রয়োজন। এখন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা না বলে নিশ্চয়ই তদন্ত কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পায়নি। তা ছাড়া এখানে সৌদি দূতাবাসের মর্যাদা ও ভাবমূর্তিও যুক্ত আছে। তাদের সেফ হোমে ভুক্তভোগীদের সব ধরনের তথ্য অবশ্যই থাকার কথা। দূতাবাসও কেন এমন কোনো উদ্যোগ নেবে না, যাতে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

দেশের দূতাবাসগুলো (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে) নিয়ে প্রবাসীদের অভিযোগের শেষ নেই। অন্যান্য দেশের শ্রমিকেরা যেভাবে তাঁদের দূতাবাস থেকে আন্তরিক সেবা–সহায়তা পান, সেখানে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর কাছেই ঘেঁষতে চান না অনেক প্রবাসী। তাঁদের সঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতামূলক মনোভাব ও অসদাচরণ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সেটির মাত্রা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তারই নমুনা সেফ হোমে এই ধর্ষণকাণ্ড। দেশের কূটনীতি অঙ্গনে এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?

দেশের অর্থনীতির বড় শক্তি হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এসব প্রবাসীর বড় অংশ হচ্ছে শ্রমিক, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই বেশির ভাগের অবস্থান। সেই রেমিট্যান্সের ওপর বাংলাদেশ কতটা নির্ভর করে আছে, করোনা মহামারির সময় মোটাদাগে প্রতীয়মান হয়েছিল। দেশে আর্থিক খাতে লোপাট ও অর্থ পাচারের মধ্যেও অর্থনীতিকে সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে এই র‍েমিট্যান্স। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া হাজার হাজার নারীও এই রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।

হাজেরা বেগম, আবিরন বেগম, শারমীন আক্তার, রীনা বেগম, শাকিলা খাতুন, ববিতা—এ রকম অনেক নাম, গুনতে গেলে শেষ হবে না। তাঁরা সবাই গৃহকর্মী। প্রথম আলোর একাধিক প্রতিবেদনে পাওয়া যাবে এ নামগুলো। তাঁদের লাশ এসেছিল সৌদি আরব থেকে। তাঁদের কেউ স্বামী পরিত্যক্ত, কেউ নির্যাতিত কিংবা বাবা বা ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত।

সন্তান বা ভাইবোনের খরচ জোগাতে কিংবা নিজের একটি ভবিষ্যৎ করতে গৃহকর্মী হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মরুর দেশে। কিন্তু তাঁদের সেই স্বপ্ন কফিনবন্দী হয়েই দেশে ফিরে আসে। প্রতি বছর এ রকম শতাধিক নারীর কফিন আসে দেশে। মৃত্যুসনদে কারণ লেখা থাকে হয় ‘স্বাভাবিক’, নয়তো ‘আত্মহত্যা’। আহারে মায়েরা আমার, আহারে বোনেরা আমার—দেশে নির্যাতন থেকে বাঁচতে বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হয়। সেটাও ঢাকা পড়ে যায় এই নামকাওয়াস্তের মৃত্যুসনদে।

তবে হাজেরা, আবিরন, ববিতারা তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছেনই বলা যায়। আরও কত নারী এখনো সৌদি আরবের কত ঘরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, আমরা জানি না। মাঝেমধ্যে দু–একজনের আহাজারি আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুনতে পাই।

কিন্তু সুরক্ষা পেতে দূতাবাসের সেফ হোমে গিয়েও কি তাঁদের রক্ষা আছে? সেখানে একজন মেহেদী হাসানের মতো ভক্ষকের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করে, তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্র ও সরকার কি তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করবে, নাকি এ রকম আরও সরকারি কর্মকর্তাকে মেহেদী হাসান হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী