কোনো একটি লেখার সূত্র ধরে এক বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনকালে বললাম, ওখানে যা লেখা হয়েছে, তা নীতিনির্ধারকদের নজরে পড়লে লজ্জা পাওয়ার কথা। বন্ধুর মন্তব্য: পত্রিকায় যা লিখা হয়, তা নীতিনির্ধারকেরা পড়েন না। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বন্ধুর মুখে এ কথা শোনার পর যে প্রশ্নটি অবধারিতভাবে চলে আসে তা হলো, ‘কেন পড়েন না?’ বন্ধুর অপকপট উত্তর: ‘পড়লে কাজ করা যাবে না’। কথায় যুক্তি আছে বটে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, তাহলে এক বিভাগের ময়দানে প্রদান করা বক্তব্যের কারণে সমালোচনার শিকার হওয়ার পর আরেক বিভাগের কর্মস্থলে বসে পাবলিক রিয়েকশন সামলাতে গিয়ে কীভাবে বক্তা বললেন, তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি আসলে ‘এটা’ বোঝাননি, ‘ওটা’ বোঝাতে চেয়েছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলেই না তিনি স্বীয় মুখ নিঃসৃত বাণীর ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা করলেন। অর্থাৎ, কেউ কেউ পড়েন তাহলে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা গণহত্যার পাঁচ বছর পার হওয়ার কথা স্মরণ করে গত এক সপ্তাহে যে সংবাদ ও মতামতগুলো প্রকাশ হয়েছে, সেগুলো রোহিঙ্গা সংকটে সংকটাপন্ন বাংলাদেশের পাবলিক সেন্টিমেন্ট বোঝার জন্য যথেষ্ট। আর রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি ইস্যুতে সরকারি সিদ্ধান্ত প্রণয়নের আগে জনমত জানা অবশ্যই প্রয়োজন।
যে রোহিঙ্গা শিশুটি ৮ বছর বয়সে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসেছিল, আজ সে ১৩ বছরের কিশোর। আর যে ১৩ বছর বয়সে এসেছিল, সে আজ ১৮ বছরের তরুণ। ইউএনএইচসিআরের এ বছরের জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ শিশু-কিশোর। ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর-তরুণকে এফডিএমএন লেবেল লাগিয়ে ক্যাম্পের আবদ্ধ পরিবেশে বসবাসে বাধ্য করার মাধ্যমে একটা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী তৈরির ব্যবস্থা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই কেবল সমাজবিরোধী আচরণই নয়, বই বা কল্যাণমূলক কাজের বদলে মাদক-অস্ত্র ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।
অপর দিকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নয়, মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বড়জোর গণহত্যা সংঘটনের বিষয়েই মূলত কথা বলে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এলে কারও কিছু করণীয় নেই বলেই রোহিঙ্গাদের পরামর্শ দেওয়া হয় ধৈর্য ধরার। একজন শরণার্থীর জীবন যেন এমনি এমনি অপচয় করার জন্যই। তিন দিনে ১৯ বার ধর্ষণের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা নারী কি স্মৃতি বয়ে বেড়ান প্রতিটি দিন, তা ধারণা করার মতো সমানুভূতি না থাকলে সবরের পরামর্শ দান সম্ভব। অধিকন্তু, মিয়ানমার দোষী সাব্যস্ত হলেই যে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরত যেতে পারবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই। পাঁচ বছরে যে সংস্থাটি একটিবারের জন্যেও মিয়ানমারে প্রবেশ করে এর সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনায় বসতে ব্যর্থ হয়েছে, সে সংস্থাটির বাংলাদেশে এসে এ বিষয়ে উপদেশ দান যেন দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত শরীরের শুশ্রূষায় তিন ইঞ্চি লম্বা একটি ব্যান্ডএইড নিয়ে এগিয়ে আসার মতো।
যুদ্ধাভিলাষী মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী বাংলাদেশ বরাবরই যে আচরণ প্রদর্শন করে এসেছে, তা মানবিকতার মাপকাঠিতে অনন্য হলেও কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। সামরিক প্রস্তুতিতে—অস্ত্রসজ্জায় বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমার অনেক এগিয়ে, এটি উভয় দেশই অবগত। সেই সঙ্গে রাশিয়া, চীন, ও সার্বিয়া—এই তিন প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারীর কাছ থেকে নিয়মিত পাওয়া অস্ত্রে মিয়ানমার সমৃদ্ধ। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, তথা বাণিজ্যিক অবরোধে পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদে বিশ্বাসী মিয়ানমার যে নতজানু হবে না, তার প্রমাণ বহু আগেই পাওয়া গিয়েছে। ২০১৯ সালে বার্মার ইতিহাস বিশারদ থন্ট মিন্ট উয়ের প্রকাশিত বইয়ে মিয়নমারকে এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, যার জন্মই হয়েছে সামরিক শক্তিচর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দায় চলে যায় যুক্তরাজ্যের দিকে। তারা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন-সার্বভৌম আরাকান রাষ্ট্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তা ভঙ্গও করেছিল। এমনকি ১৮৭২ ও ১৮৯১ সালের গণশুমারি থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ রেখেছিল, যা পরবর্তী সময় মিয়ানমারের জন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পথ প্রশস্ত করে দেয়। পরবর্তী সময় ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ ছিনিয়ে নেওয়া, দেশের অভ্যন্তরে বাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়া, আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে মিথ্যাচার এবং আদালতের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অভ্যন্তরে মর্টার শেল নিক্ষেপ করেও কোনো স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি না দিয়ে নিশ্চুপ থাকা—এসব আচরণ তাদের একরোখা, বেপরোয়া ও স্বার্থান্বেষী বৈশিষ্ট্যই নির্দেশ করে। মর্টার শেলটি যদি বাংলাদেশের ঘুমধুমে না এসে ঘুমধুম থেকে মিয়ানমারের মাটিতে গিয়ে পড়ত, তাহলে বিশ্ব নিশ্চুপ থাকত না, বা বাংলাদেশের মতো কারণ ‘খতিয়ে দেখার’ জন্য সময় ব্যয় করত না।
রোহিঙ্গা গণহত্যা পঞ্চম বর্ষে পা দিয়েছে। দিবসটি স্মরণে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের আঞ্চলিক শরণার্থী সমন্বয়কারী ম্যাক্যানজি রোও যা বললেন, তা অনেকটা নিজ গৃহে রোহিঙ্গাদের জন্য আরেকটু পাকাপাকি বন্দোবস্ত করার মতো শুনালেও তা-ই বাস্তব। তাঁর মতে, জরুরি পরিস্থিতির সহায়তা কার্যক্রমের পরিবর্তে এখন আরও টেকসই ব্যবস্থায় যেতে হবে, যা রোহিঙ্গাদের জন্য তো বটেই, তাদের দক্ষতা এবং জীবিকা উন্নয়ন ঘটানো হলে সেটা কক্সবাজার জেলার প্রতিটি মানুষের জীবনে স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার উন্নয়ন ঘটাবে।
প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি শরণার্থী সমস্যা সমাধানের অন্য দুটি পন্থা নিয়ে কথা উঠলেই অতীতে বলা হয়েছে এগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারকে ভুল বারতা দেওয়া হবে। বারতা অনেক আগেই ভুলভাবে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তো বটেই, স্বয়ং মিয়ানমারও বিস্মিত হয়েছিল। কারণ, বিশ্বের বুকে এ ধরনের দৃষ্টান্ত নেই। রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়কে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে এক করে দেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার তখন আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রচারণা চালাল যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেরই মানুষ। সেই সঙ্গে মিয়ানমারকে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক আলোচনায় বসাতে বাংলাদেশের ব্যর্থ হওয়া, আলোচনা হলেও সে আলোচনায় বাংলাদেশ তার নিজের অনুকূলে নেওয়া সিদ্ধান্তে মিয়ানমারকে অটল থাকতে বাধ্য করাতে ব্যর্থ হওয়া, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো ইত্যাদি বহুবিধ ঘটনায় ভুল বারতা ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে। সুতরাং, প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি বিকল্প কিছু ভাবলে ক্ষতি নেই। তাতে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের মানুষ—উভয়ের জন্যই ভালো।
‘আমাদের আর অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দাদের রক্তের গ্রুপ এক রকম।…আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগে তারা (ভারতবর্ষের মানুষ) অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে প্রথম পৌঁছায়।’ পিনাকী ভট্টাচার্যের ‘সোনার বাঙলার রূপালী কথা’য় অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের মিলের কথা বলা আছে, বিশ্বের বহু জাতির ইতিহাসে অন্য জাতির সঙ্গে মিল স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আজকের মিয়ানমার এটি মানতে নারাজ যে একসময় ভারত-বাংলাদেশ-বার্মা এক অঞ্চল ছিল বিধায় এ মানুষগুলোর মধ্যে মিল থাকা স্বাভাবিক। অবশ্য বাণিজ্যিক লাভ যেখানে মুখ্য, গণহত্যা সেখানে গৌণ।
সম্প্রতি আমেরিকার বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়ার মতো রোহিঙ্গা গ্রহণের কথা জানানোর পর এক পক্ষ বলছে, কয়েক হাজার রোহিঙ্গা আমেরিকায় যাওয়া থেকে কয়েক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে যাওয়া ভালো। অপর দিকে সরকারিভাবে একে সাধুবাদ জানানো হচ্ছে, ‘বেশি করে রোহিঙ্গা’ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। জাপান, কানাডা, যুক্তরাজ্যও নাকি রোহিঙ্গা নিতে আগ্রহী। এটি স্পষ্ট যে তাদের কেউ–ই কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা ছাড়া এ–জাতীয় ঘোষণা দেবে না। সেটি বিশ্লেষণের জন্য নিশ্চয়ই কূটনীতিবিদেরা আছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ কূটনীতির চর্চা থেকে নেওয়া শিক্ষা তাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনে বাংলাদেশের সফলতায় কাজে আসবে কি?
২০০৬-২০১০ সময়ে তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় কানাডা পাঠানোর পর যেসব কারণে এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়, তা মোটামুটিভাবে জানা থাকলেও সরকারিভাবে আজও জানানো হয়নি, কেন তা বন্ধ হলো এবং কেন আবার তা চালু করা সম্ভব নয়। এমনকি ২০১৮ সালে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে সহায়তার প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ নীরব থেকেছে। তাদের অফার সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গার জন্য ছিল বটে, যা বাংলাদেশে বাসরত এক মিলিয়ন রোহিঙ্গার তুলনা নগন্য। কিন্তু ছোট করে হলেও পুনর্বাসনের কাজটি অনেক আগে শুরু হতে পারত।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যদি হিন্দুধর্মাবলম্বী হতো, তাহলে ভারত কি নিশ্চুপ থাকত? অথবা, যদি খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী হতো, তাহলে আমেরিকা-ইউরোপ হাত গুটিয়ে বসে থাকতো কি? কিংবা যদি বৌদ্ধ হতো, তাহলে মিয়ানমারের ‘পাকফো ফ্রেন্ড’ চীনের ভূমিকা কেমন হতো? অবশ্য রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ হলে মিয়ানমার গণহত্যাকারীর খাতায় নাম লেখাত না।
সব রোহিঙ্গা নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চায়। কেউ কেউ মিয়ানমার ছাড়া পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় যেতে রাজি। এ বিষয়গুলো আমলে নিয়েই যেন পুনর্বাসনের উদ্যাগ নেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন হওয়ার কারণে অসহায়, আর বাংলাদেশ অসহায় অন্য রাষ্ট্রের সমর্থনের অভাবে। বলা বাহুল্য, সৌদি আরবসহ আরও কিছু দেশে রোহিঙ্গারা যেমন বাংলাদেশি পরিচয়ে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-যুক্তরাজ্য যাওয়ার ডামাডোল শুরু হলে বাংলাদেশেরও কেউ কেউ যে রোহিঙ্গা হিসেবে নাম লেখাবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মিস রোও এর প্রস্তাব কি রোহিঙ্গাদের পাকপাকি ঠাঁই দেওয়ার কথা বলছে?
রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করা দক্ষিণ সুদান বা কঙ্গোর শরণার্থীদের দেখাশোনা করার মতো নয়। কারণ, সেখানকার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্লান্তিকর দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে শরণার্থীদের কাছে যাওয়া বা অনিরাপদ পরিবেশে দাতা সংস্থার কর্মীদের কাজ করতে হয় না। সম্ভবত কক্সবাজারের মতো শান্ত, নিরাপদ ও আরামদায়ক পন্থায় শরণার্থী ব্যবস্থাপনা আর কোথাও নেই। সে কারণে রোহিঙ্গা সংকট যত বেশি স্থায়িত্ব লাভ করবে, তত বেশি দিন দাতা সংস্থার কর্মস্থল হিসেবে কক্সবাজার থাকবে পছন্দের শীর্ষে। আর কয়দিন পর ভাসানচরও এই তালিকায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
সবরের পরিচয় দিতে দিতে রোহিঙ্গারা ক্লান্ত হয়ে গেলেও বিশ্বের কোনো আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার হয় না। আসিয়ান, কিংবা ওআইসির মতো আঞ্চলিক সংস্থা রাষ্ট্রের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ হতে পারে ভেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো কথা বলে না। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো যেহেতু বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে, মিয়ানমারের কোন গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বলবে রোহিঙ্গারা?
রোহিঙ্গা গণহত্যা পঞ্চম বর্ষে পা দিয়েছে। দিবসটি স্মরণে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের আঞ্চলিক শরণার্থী সমন্বয়কারী ম্যাক্যানজি রোও যা বললেন, তা অনেকটা নিজ গৃহে রোহিঙ্গাদের জন্য আরেকটু পাকাপাকি বন্দোবস্ত করার মতো শুনালেও তা-ই বাস্তব। তাঁর মতে, জরুরি পরিস্থিতির সহায়তা কার্যক্রমের পরিবর্তে এখন আরও টেকসই ব্যবস্থায় যেতে হবে, যা রোহিঙ্গাদের জন্য তো বটেই, তাদের দক্ষতা এবং জীবিকা উন্নয়ন ঘটানো হলে সেটা কক্সবাজার জেলার প্রতিটি মানুষের জীবনে স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার উন্নয়ন ঘটাবে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হামিদ আল বার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসে আয়োজিত বক্তব্যে যা বললেন, তা হুবুহু মিস রোও-এর কথার মতো না হলেও সহজেই বোঝা যায়, কেবল প্রত্যাবাসনের আশায় বসে থাকা অর্থহীন।
পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী জিগমান্ট বম্যানের মতে, বিশ্বায়ন রাষ্ট্রগুলোকে নিজের স্বার্থ অনুযায়ী মানুষে মানুষে বিভেদ করতে শিখিয়েছে; শরণার্থীরা এই বিভাজনের শিকার হয়ে পরিণত হয় ‘মানব বর্জ্যে’ (human waste), চলে যায় বাতিলের খাতায়। রাষ্ট্রের মর্জির ভিত্তিতে সৃষ্ট বিভাজনের শিকার শরণার্থী মানুষগুলো সেই রাষ্ট্রে আশ্রয় পাবে কি না, ‘নাগরিকের’ মর্যাদা পাবে কি না, তা জানার জন্য কেবল অপেক্ষাই করে যায়। মানবিক বিবেচনা এখানে প্রায় অর্থহীন। ইউক্রেনের জনগণ শরণার্থী হিসেবে পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় পেয়েছে, জাপান সরকারের একজন মন্ত্রী নিজের সঙ্গে উড়োজাহাজে করে তাদের জাপানে নিয়ে গিয়েছেন। এসবের পেছনে মানবিকতা ছাপিয়ে ছিল রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ।
ঠিক তেমনি মিয়ানমার তার নিজের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে রোহিঙ্গা নিধনে মত্ত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় হয়েছে সেই নিধনযজ্ঞ পরিচালনার হাতিয়ার। আর বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দিলেও তাদের এবং নিজ দেশের মানুষের জন্য সংকটকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে দুর্বল কূটনীতির কারণে তাদের ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে। এসবের মধ্যে রোহিঙ্গারা প্রাণে বেঁচেছে এটা ঠিক, কিন্তু ক্রমে পরিণত হচ্ছে ‘মানব বর্জ্যে’। তার ওপর বাংলাদেশে শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় যেহেতু কোনো আইনি কাঠামো নেই, নিজ দেশের ভেতরে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা এবং তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের প্রস্তাবে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে—সে বিষয়গুলোও অস্পষ্ট।
নিবন্ধিত শরণার্থীদের তৃতীয় প্রজন্ম বাস করছে এখন বাংলাদেশে—অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও পরিচয়ের সংকট নিয়েই। অনিবন্ধিত এফডিএমএনরাও পাঁচ বছর পার করে ফেলেছে। তাদের প্রত্যাবাসন কোনো এনজিও বা দাতা সংস্থার ম্যান্ডেট নয়। সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আগে কেবল প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় না থেকে ‘মানব বর্জ্য’কে কীভাবে মানবসম্পদে পরিণত করা যায়, সে বিষয়ে ভাবার সময় হয়েছে বটে। এ জন্য নীতি এবং বাস্তব উদ্যোগে—উভয়ই প্রয়োজন। কোনো নীতি না থাকাটাও একটা নীতি—এ–জাতীয় দায়হীন ভাবনা ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় তো বটেই, ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশ বা অঞ্চল থেকে আসা জনজোয়ার সামলানোর ক্ষেত্রেও দেশকে মুশকিলে ফেলবে।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।