মতামত

সুদান সংঘাত: রাশিয়া ও চীনের স্বার্থ যেখানে এক নয়

সুদানের সামরিক বাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে চলমান সংঘাত ও সুদানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি সরকারগুলোর ভূমিকা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
সুদান সংঘাতে স্বাভাবিকভাবেই, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আফ্রিকায় বিশেষ করে সুদানে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশগুলো। গবেষকদের উদ্বেগ হচ্ছে, সুদানসহ আফ্রিকার দেশগুলোয় অবকাঠামো ও উন্নয়ন খাতে চীন যে ঋণ দিচ্ছে, সেটা আসলে ‘ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি’। এটা মূলত বন্দরসহ প্রধান প্রধান অবকাঠামো করায়ত্ত করার আগ্রাসী পদক্ষেপ।

বিশ্লেষকেরা দেখিয়েছেন যে আফ্রিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পৃক্ততার কারণ হলো, বেইজিং বিদেশের মাটিতে তাদের সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায়। অন্য বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আফ্রিকায় রাশিয়া অস্ত্র বিক্রি, যৌথ সামরিক মহড়া ও সুদানের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আফ্রিকায় সোভিয়েত জমানার প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চায়।

সম্প্রতি রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা দল ভাগনার গ্রুপ সুদানের সংঘাতে তাদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে এক পোস্টে ভাগনার কর্তৃপক্ষ বলেছে, ‘অসংখ্য বিদেশি সংবাদমাধ্যমে সুদান নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হচ্ছে। বেশির ভাগই প্ররোচনামূলক। আমরা প্রত্যেকের বিবেচনার জন্য জানাচ্ছি যে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ভাগনার গ্রুপের একজন সদস্যও সুদানে নেই।’

সর্বোপরি সুদান সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার আচরণগত ভিন্নতা স্পষ্ট করেই দেখা গেছে। সুদানে যুদ্ধ–পূর্ববর্তী রাশিয়ার কর্মকাণ্ড চলমান সংঘাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়ার তৈরি যুদ্ধবিমান সুদানের শহরগুলোয় হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে, সংঘাতকবলিত সুদান থেকে লোকেদের ও বিদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে চীন।

এডিনবার্গ ল স্কুলের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্তর্জাতিক গবেষণা কনসোর্টিয়াম পিসরেপ থেকে সম্প্রতি একটি গবেষণা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আফ্রিকায় রাশিয়া ও চীনের লক্ষ্যকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আফ্রিকার ক্ষেত্রে বেইজিং ও মস্কোর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। আফ্রিকায় চীনের নিজস্ব একগুচ্ছ স্বার্থ থাকলেও মহাদেশটিতে চীন যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটা মূলত স্থিতিশীলতার পক্ষে।

আফ্রিকায় শান্তি রক্ষা ও সংঘাত নিরসনের মতো বিষয়ে বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বিপরীতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে খুব বেশি সহযোগিতা না করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে আগ্রহী মস্কো। গবেষণা প্রতিবেদনে পাওয়া যাচ্ছে, শান্তি রক্ষা ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার মতো বিষয়ে চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে বাণিজ্য, অনুদান অথবা শান্তি রক্ষার মতো বিষয়েও অস্ত্র বিক্রিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে রাশিয়া।

সুদানের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া ও চীনের পদক্ষেপগুলো কতটা ভিন্ন। গত দুই দশকে চীন থেকে সুদান কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা ও বিনিয়োগ পেয়েছে। এ অর্থ দিয়ে সুদান তেল উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে।
অন্যদিকে সুদানে দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা অংশীদার রাশিয়া। সুদান বন্দরে নৌঘাঁটি স্থাপন করতে আগ্রহী মস্কো।

চীন ও রাশিয়া দুই দেশই সুদানে অস্ত্র বিক্রি করেছে এবং জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অংশ নিয়েছে। জাতিসংঘের কমট্রেড তথ্যভান্ডার থেকে দেখা যাচ্ছে, সুদানে চীনের বিনিয়োগ রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। তবে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় সুদান থেকে চীনের আমদানি বাণিজ্য বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে। কেননা, দক্ষিণ সুদানেই তেলের সিংহভাগ মজুত।

২০১১ সালে সুদান থেকে চীনের আমদানি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এর পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ১০ বছর পর ২০২১ সালে চীন তাদের সেই আমদানি বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। কিন্তু এই ১০ বছরে চীনের রপ্তানি বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কোভিড মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালে চীন সুদানে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।

সুদানের প্রধানতম ঋণদাতা দেশ চীন। গত দুই দশকে সুদানকে চীন কয়েক বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। অনেকে সমালোচনা করেন যে এটি ঋণ দিয়ে ফাঁদে ফেলার কূটনীতি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সুদানকে ঋণের জাল থেকে মুক্ত করতেও ঋণ দিয়েছে বেইজিং।
পক্ষান্তরে সুদানে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা সামান্য। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। সে কারণে সুদান থেকে তাদের তেল কেনার প্রয়োজন নেই। সুদানকে দেওয়া রাশিয়ার সহায়তা ও ঋণ দেওয়ার পরিমাণও অনেক কম।
সুদানে বৈশ্বিক বহুপক্ষীয় সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রেও রাশিয়ার চেয়ে চীন অনেক বেশি এগিয়ে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের মধ্যে চীন জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী দেশ। অন্যদিকে রাশিয়া জাতিসংঘ সুদান মিশনে সামান্য কয়েকজন শান্তিরক্ষী নিয়োগ দিয়েছে।

সর্বোপরি সুদান সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার আচরণগত ভিন্নতা স্পষ্ট করেই দেখা গেছে। সুদানে যুদ্ধ–পূর্ববর্তী রাশিয়ার কর্মকাণ্ড চলমান সংঘাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়ার তৈরি যুদ্ধবিমান সুদানের শহরগুলোয় হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে, সংঘাতকবলিত সুদান থেকে লোকেদের ও বিদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে চীন।

  • মার্সেল পিলিচটা স্কটল্যান্ডের সেন্ট আন্ড্রুজস বিশ্ববিদ্যালয়েরর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত