আন্ডার ইনভয়েসিং আর হুন্ডি—কে কাকে ধরে রাখে?

হুন্ডির ব্যবসা যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়াকে সহজ করে আমদানির আন্ডার ইনভয়েসিংকে সহায়তা করে কিংবা অবৈধভাবে বিদেশে ডলার পাচারের ভূমিকা রাখে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরা তা পারেন কেন?

অন্যভাবে বললে, হুন্ডির ব্যবসা রমরমা কেন? কিংবা হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসী আয় বেশি আনতে পারছেন কেন? তাঁরা আকর্ষণীয় অফার দিতে পারলে ব্যাংক পারছে না কেন? এই বিষয়ে অনেকেই পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। বিশেষ করে, ডলার হার ও লেনদেন সহজবোধ্যতার দিক থেকে। অর্থাৎ যাঁরা বিদেশ থেকে ডলার পাঠাচ্ছেন, তাঁরা এটাকে সহজ ও লাভজনক মনে করছেন। কিন্তু চাহিদার দিক খুব বেশি আলোচনা করতে দেখি না। আমার কাছের ব্যবসায়ী বন্ধুদের দেখেছি, আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং করার জন্য হুন্ডি দিয়ে ডলার পাঠাতে রপ্তানিকারকদের কাছে।

সম্প্রতি একটি সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (পণ্যের দাম কম দেখানো) মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের কথা জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ১ লাখ ডলারের মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের গাড়ি নাকি ২০ হাজার ডলারে আমদানির জন্য এলসি বা ঋণপত্র খোলা হয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ওই গাড়ি আমদানির জন্য আমদানিকারক ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে বাকি ৮০ হাজার ডলার রপ্তানিকারককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মার্সিডিজ গাড়ির ক্ষেত্রে যে বিশাল শুল্ক সরকারকে পরিশোধ করতে হতো, আমদানিকারকেরা তা ফাঁকি দিয়েছেন। অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও আন্ডার ইনভয়েসিং আরও সহজেই করতে পারার কথা এবং তা হচ্ছেও। কেন হচ্ছে?

বর্তমানে বাংলাদেশের গড় শুল্কহার ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ। তাহলে যে পরিমাণ ডলার হুন্ডিতে পাঠানো হবে তার ওপর থেকে একজন ব্যবসায়ী গড়ে ওই শুল্কহারের সমপরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিতে পারবেন। যেখানে হুন্ডিতে ডলার পাঠাতে ৩, ৪ কিংবা ৫ শতাংশের মতো বেশি খরচ পড়ে এবং আমদানি ব্যবস্থাপনায় জড়িত ব্যক্তিদের একটা অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে তা করতে দেন সেখানে আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং হবেই। শুল্কহার শূন্য থাকলে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে কোনো ধরনের প্রণোদনা থাকত না ব্যবসায়ীদের এই ধরনের শুল্ক ফাঁকির প্রচেষ্টায়। যেহেতু শুল্কহার অনেক বেশি তাই শুল্ক ফাঁকির জন্য হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিং করবেই। আবার যখন শুল্কহার আরও বেড়ে যাবে, তখন তাঁদের দিক থেকে এ ফাঁকির প্রচেষ্টা আরও বাড়বে। ব্যবসায়ীদের ঔচিত্যবোধ দিয়ে এটাকে দেখলে হবে না।

বাজারে ডলার কেনাবেচা করে মুনাফা অর্জন করে ব্যাংক এবং এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো, তাদের ওপর ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া মানে বাজারের প্লেয়ারদের কিংবা তাদের সমিতির ওপর ছেড়ে দেওয়া নয়। বর্তমান ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে বাজারকে বাজারের মতো চলতে দেওয়ার ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশে সাধারণত ব্যাংকিং খাত ও হুন্ডি মার্কেটের মধ্যে ডলারের রেট ৩, ৪ কিংবা ৫ শতাংশের মতো পার্থক্য দেখা যায়। সাধারণত হুন্ডি মার্কেটের ডলার রেট ২, ৪ কিংবা ৫ টাকা বেশি থাকে। যেহেতু গড় শুল্কহার ৩০ শতাংশের মতো, তাই হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে আমদানির আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটা লাভজনক হওয়ার কারণে ব্যাপক মাত্রায় আমদানির আন্ডার ইনভয়েসিং হয় বাংলাদেশে। কিন্তু সম্প্রতি হুন্ডি মার্কেটে ডলারের রেট কখনো কখনো ১০, ১৫ কিংবা ২০ শতাংশের মতো বেশি হতে দেখা যায়। অবশ্যই সেটা চাহিদার কারণে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মাধ্যমে ডলার বেশি চাইছেন কিংবা অন্য কোনো কারণে হুন্ডির মাধ্যমে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। সম্প্রতি ডলার রিজার্ভে টান পড়ার কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য বেশ কিছু পণ্যের শুল্কহার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাতে আন্ডার ইনভয়েসিং আরও লাভজনক হয়ে যায়। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত থেকে ডলার প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা অতিমাত্রায় হুন্ডির ডলারের দ্বারস্থ হন।

অন্যদিকে, অনেক দিন ধরে ডলারের রেট একই পর্যায়ে রাখার ফলে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে টাকার ওপর সুদের হার কম থাকার কারণে অনেকেই টাকা ছেড়ে ডলার কিংবা সোনা কিনে রাখার ওপর জোর দেন। হঠাৎ ডলার রেট বেড়ে গেলে একলাফে অনেকটা লাভ করা যাবে এই প্রত্যাশায়। এই ধরনের হঠাৎ বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতিতে বিনিময় হার ওভার শুটিং বলে। এই ধরনের প্রত্যাশার কারণে রপ্তানিকারকেরা তাদের ব্যাংকে থাকা রপ্তানি থেকে অর্জিত ডলার নগদায়ন করা থেকেও সাময়িক বিরত থাকে। সবকিছু মিলিয়ে ডলারের একটা বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হওয়ার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থাৎ হুন্ডির ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম আকস্মিক অনেক বেড়ে যায়। উল্লেখ্য, নানাবিধ কারণে হুন্ডি ও  কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম প্রায় সমর্পযায়ে থাকে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে পাঠানো অর্থ আরও বেশি লাভজনক হওয়ায় প্রবাসীরা তাঁদের আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

অবাক ব্যাপার হলো, হুন্ডিতে ডলার রেট বেশি হলে সরবরাহের দিক থেকে বেশি ফান্ড এখানে আসবে। অর্থাৎ প্রবাসীরা এই মাধ্যমে বেশি অর্থ পাঠাবেন, কিন্তু চাহিদাকারীরা এই চ্যানেল থেকে কম পরিমাণে ডলার নিতে চাওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি। প্রথমত, হুন্ডির মাধ্যমে ডলার রেট বাড়লেও শুল্কহারও বেড়েছে, তাই হুন্ডির ডলার ব্যবহারে মুনাফা মার্জিন কমার কথা নয়। বরং বাংলাদেশের মতো অপেক্ষাকৃত কম প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটে মুনাফা আরও বাড়ার কথা। দ্বিতীয়ত, ফটকাবাজারি বা স্পুকেলেটিভ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে অনেক বেশি চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে প্রবাসীরা যত বেশি অর্থ এই মাধ্যমে পাঠাচ্ছিলেন, ততটাই চাহিদাকারীরা নিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রবাসী আয়ের ওপর প্রণোদনা বাড়িয়েও ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পুলিশি উপায়ে এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ায় সমস্যা সমাধানের চেয়ে তা আরও প্রকট হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রবাসী আয় আনার ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু তাকে যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে (কার্ব ও হুন্ডি মার্কেট) বিবেচনায় আনতে হবে, তা কখনো মানতে দেখছি না। সরবরাহের দিক থেকে হুন্ডি মার্কেটের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের যে প্রতিযোগিতার সম্পর্ক তা মাথায় রেখে নীতিনির্ধারণ করতে হবে। হুন্ডি দিয়ে ডলার এলে দেশের কাজে লাগবে না, ব্যাংক দিয়ে এলে রিজার্ভে যোগ হবে এবং দেশের কাজে লাগবে। এই ধরনের খোঁড়া যুক্তি কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়, তা–ও বোধগম্য নয়। তবে হ্যাঁ, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বেশি ডলার নিয়ে আসতে পারলে সরকারের শুল্ক রাজস্বের দিক থেকে আরও ইতিবাচকভাবে ডলারকে ব্যবহার করা যাবে। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা এবং আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে হুন্ডি বন্ধ করে পাচার কতটা ঠেকানো যাবে, তা বির্তকের বিষয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে হুন্ডি মার্কেটকে নীতিনির্ধারণের সময় ধর্তব্যে আনতে হবে।

হুন্ডি মার্কেটকে বিবেচনায় আনলে অবশ্যই শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি কমানোর ওপর গুরুত্ব দিত না বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর। বরং কিছু পণ্য আমদানি করাই যাবে না এমন অবস্থান নিতে হতো। অন্যদিকে, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়ার কথা বললে অবশ্যই হুন্ডি মার্কেটকে বিবেচনায় আনতে হবে। এই দুই খাতের মিথস্ক্রিয়াকে মাথায় রাখতে হবে। অবৈধ মানি ট্রান্সফার চ্যানেল বলে আইনানুগ ব্যবস্থা দিয়ে একে অস্বীকার করা যাবে না। বরং শুল্ক ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে হুন্ডি চ্যানেলের মাধ্যমে ডলারের চাহিদা এমনিতেই কমে যাবে। শুল্কহার আস্তে আস্তে কমে এলেও হুন্ডির মাধ্যমে ডলারের চাহিদা কমে যাবে। অন্যথায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এটা বন্ধ করা যাবে না।

সবশেষ, বাজারে ডলার কেনাবেচা করে মুনাফা অর্জন করে ব্যাংক এবং এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো, তাদের ওপর ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া মানে বাজারের প্লেয়ারদের কিংবা তাদের সমিতির ওপর ছেড়ে দেওয়া নয়। বর্তমান ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে বাজারকে বাজারের মতো চলতে দেওয়ার ক্ষেত্রেও।

সবশেষ কথা হলো, বর্তমানে যেভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলার রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা অচিরে বুমেরাং হতে পারে। উৎপাদনের আমদানি সংবেদনশীলতা বিবেচনায় এনে যেসব খাত অতিমাত্রায় আমদানি নির্ভরশীল, তার ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের আমদানি নিয়ন্ত্রণ কৌশল অবলম্বন করা অতীব জরুরি।

  • ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; পরিচালক (গবেষণা), সিরডাপ।