মতামত

ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যে ‘হ্যান্ডবুক’ অনুসরণ করে চলেছে

‘বৈষম্যবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হ্যান্ডবুক লিখেছে এবং ৭৫ বছর ধরে এর প্রতিটি অক্ষর মেনে চলেছে।’
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আমি নতুন করে আবারও নোয়াম চমস্কি ও ইলান প্যাপের গাজা ইন ক্রাইসিস বইটা পড়তে শুরু করলাম। বইটা লেখা হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু  গাজায় এখন যা চলছে, অদ্ভুতভাবে তারই আরেকটা সংস্করণ পড়ছি বলে মনে হলো। যেমন প্যাপ বলেছেন, বেসামরিক জনগণকে যন্ত্রণা দেওয়ার কৌশল ইসরায়েলিদের কাছে পুরোনো। এটা ইসরায়েলের রাজনৈতিক মতবাদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অংশ। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই কৌশলই তাদের প্রধান চালিকা শক্তি।

প্যাপ ২০০৮–০৯ সালে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলিদের যুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ করেছেন। ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমির স্নাতকোত্তীর্ণদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ওই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। হামলায় তৎক্ষণাৎ ২০০ জন নিহত হন, আহত হন আরও ৭০০ জন। ইসরায়েল মনে করে, বেপরোয়া হামলা তাদের ফিলিস্তিনের থেকে এগিয়ে রাখবে। বাছবিচারহীনভাবে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করার এই কৌশল ১৯৫০ সাল থেকে তারা অনুসরণ করে আসছে।

ইসরায়েলের সাবেক জেনারেল ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দাইয়ান একবার বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলকে পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করতে হবে, খেপালেই বিপদ, এমন একটা ধারণা যেন সবার মনে গেঁথে যায়।’ তাঁর এ বক্তব্য ছাপা হয়েছিল ২০১১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। লুইস রেন বেরেস ও জন টি চেইন বলেন, দাইয়ান আসলে বলে দিয়েছেন যে তাঁরা না বোঝার ভান ধরে যা ইচ্ছে তাই করেন।

অধ্যাপক প্যাপ সাবাথের (ইহুদিদের ধর্মীয় আচার) দুই সপ্তাহ পর ইসরায়েলিরা গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। এর আগেই গাজায় তারা বোমা ফেলে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং প্রাণহানি পৌঁছেছে হাজারের কাছাকাছি। গাজা তখনো অবরুদ্ধ এবং ইসরায়েল সেখানে কোনো সহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তখন বলল সাবাথের জন্য সীমান্ত পারাপার বন্ধ রাখা হয়েছে। প্যাপ তাঁর বিরক্তি চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি প্রশ্ন তুললেন, তাহলে এই পবিত্র ধর্মানুষ্ঠানের মর্যাদা বজায় রাখতে ফিলিস্তিনিরা যারা কোনোরকমে বেঁচে আছে, তাদের খাবার ও ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে? মার্কিন জেট বোম্বার ও হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলে শত শত মানুষকে হত্যা করতে হবে?

বৈষম্যবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হ্যান্ডবুক লিখেছে এবং ৭৫ বছর ধরে এর প্রতিটি অক্ষর মেনে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বারাক ওবামা ও তাঁর পূর্বসূরিদের সবুজসংকেত দিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। আর অন্য রাজনীতিকেরা জায়নবাদীদের বেদিতে পূজা দিয়ে গেছেন। যেসব সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না, তাঁদের নিজেদের নিয়ে লজ্জিত হওয়া উচিত।

প্যাপ বলেন, ‘১৯৮২ সালের জুনে লেবাননে মার্কিন সমর্থিত ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রথম শিকার হয়েছিল ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবির। সাবরা ও শাতিলা নামের ওই দুই শিবিরে তারা বোমা হামলা চালায়।’ আইডিএফের চালানো ওই হামলা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, স্থানীয় হাসপাতালে বোমা হামলায় ২০০ লোককে হত্যা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক ‘সহযোগিতা’য় ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ নিহত হন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে প্রকাশ্য দখলদারি বন্ধে প্রস্তাব আনা হলে তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।

প্যাপ লেখেন, ইসরায়েলিরা তীব্র রকেট হামলার মধ্যে বেঁচে আছেন বলে যাঁরা ইসরায়েলের হামলাকে হালাল করতে চান, সেসব মানুষের বক্তব্যের সঙ্গে  এই অবস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ পশ্চিমের এই লোকগুলোর উচিত এরপর প্যাপ কী বলেছেন, তা লিখে নেওয়া। সামরিক বিশ্লেষক যিভ শিফকে উদ্ধৃত করে তিনি লেখেন, ‘ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সব সময় বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা করেছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং সজ্ঞানে...(সেনাবাহিনী) কখনো সাধারণ মানুষকে সামরিক লক্ষ্যবস্তু থেকে আলাদা করেনি।’

এই দফায় আমরা আবারও দেখলাম গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বেসামরিক জনগণকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে। হাসপাতাল ও অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্রে হামলা চলছে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি বাবারা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বোমার আঘাতে মৃত সন্তানের শরীরের কোনো একটা অংশ বুকে চেপে কাঁদছেন। খাবার, ওষুধ এবং অন্যান্য জরুরি সেবা থেকে ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করছে বিশ্বের স্বঘোষিত ‘সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী।’

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে যেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে। সঙ্গে দিয়েছে কূটনৈতিক সমর্থন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজে ইসরায়েলে উড়ে গেছেন, গিয়ে বলেছেন, আপনারা একা নন; এবং হ্যাঁ যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় সংসদে নিরাপত্তা কাউন্সিলে মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশ করানোর জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যেটি এই প্রস্তাবে ভেটো দেয়; রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড কিছুটা অদ্ভুতভাবে বলেছেন, ‘আমরা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমরা বিশ্বাস করি, কূটনীতিকে তার ভূমিকা পালন করতে দেওয়া উচিত। নিরাপত্তা পরিষদে আমরা যা দেখলাম, তা তো কূটনীতিই। তাঁর বিকৃত, জায়নবাদী চিন্তাভাবনায় জোরালো কূটনৈতিক চেষ্টা ইসরায়েলকে শুধু বেসামরিক জনগণের ওপর বোমা হামলার পথ করে দিচ্ছে। তাদের কাছে খাবার, পানি বা স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার চেয়েও বোমা হামলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তাই এরপর যখনই আমরা পশ্চিমা রাজনীতিকদের ইসরায়েলি বর্বরতাকে ‘আত্মরক্ষা’ বলে আখ্যা দিতে শুনব, তখনই ধরে নেব তাদের এ কথায় নতুন কিছু নেই। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর দশকের পর দশক হামলা চালিয়ে এসেছে। কোনো ওজর-আপত্তিই তাদের ঠেকাতে পারেনি।

চলমান সংঘাত শুধু হতাহতের সংখ্যার দিক থেকে আগের হামলাগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। বৈষম্যবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হ্যান্ডবুক লিখেছে এবং ৭৫ বছর ধরে এর প্রতিটি অক্ষর মেনে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বারাক ওবামা ও তাঁর পূর্বসূরিদের সবুজসংকেত দিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। আর অন্য রাজনীতিকেরা জায়নবাদীদের বেদিতে পূজা দিয়ে গেছেন। যেসব সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না, তাঁদের নিজেদের নিয়ে লজ্জিত হওয়া উচিত।

  • ইব্রাহিম হিউওয়েট সাংবাদিক ও মিডল ইস্ট মনিটরের সম্পাদক
    মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ