আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শিশুদের বয়সসংক্রান্ত নতুন সুপারিশ করেছে। এই কমিটির সুপারিশ ৪ ও ৫ জুলাই প্রথম আলোর খবরে পড়েছি। সুপারিশের মোদ্দাকথা যা খবরে পড়েছি, সেটা হলো বর্তমান আইনে বিদ্যমান শিশুর বয়সসীমা ১৮ বছর থেকে কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো শিশু খুনসহ ভয়ংকর কোনো অপরাধ করলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ড। কোনো শিশুর কারাদণ্ড হলে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সে থাকবে কিশোর সংশোধনাগারে এবং পরে প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। ১৮ বছর বয়সের কম কোনো শিশু সাধারণ অপরাধে জড়িত হয়ে পড়লে তাকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শিশু আইনে শিশুদের অধিকার ও শিশুদের প্রতি আচরণবিষয়ক বিভিন্ন অন্তর্জাতিক সনদ (কনভেনশন) ও দিকনির্দেশনার (গাইডলাইন) শুধু প্রতিফলনই ঘটেনি, বরং সেগুলোর সুচারুভাবে অনুসরণ করা হয়েছে।
এটা অনস্বীকার্য যে ইদানীং শিশুদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া ও গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পত্রিকায় আসছে। বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ও অপরাধ বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এসব উদাহরণ বিবেচনায় নিয়ে শিশু আইনে শিশুর বয়স কমানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। কমিটি আরও বলেছে যে আন্তর্জাতিক সনদ ও মানদণ্ড প্রতি ক্ষেত্রে এবং অক্ষরে অক্ষরে মানা অযৌক্তিক। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, মানদণ্ড বা সনদ বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে পরীক্ষা করে আমাদের জন্য তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের প্রেক্ষাপটে ১৮ বছরের সীমারেখাটা কতটা বাস্তবধর্মী, সেটা দেখতে হবে। এক অর্থে কথাগুলো যৌক্তিক, কিন্তু অন্য অর্থে মহা ভয়ংকর ও ভয়ানক।
একটু পেছনের ইতিহাস ঘাঁটলে এটা স্পষ্ট হবে যে শিশু আর প্রাপ্তবয়স্কদের ফারাক বা পার্থক্য মানবসভ্যতার ইতিহাসে খুব আগে নয়। ক্যামেরা আবিষ্কারের আগে ছবি হতো রং–তুলি অথবা পেনসিল–কলম দিয়ে এঁকে। সতেরো শ সালের আগে-পরে যেসব শিশুর ছবি আঁকা হয়েছে, সেখানে শিশুদের পোশাক–আশাক ছিল বয়স্ক বা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো। বহু দশকের আঁকা ছবিগুলো দেখে বলা হয়েছে যে শিশুদের আলাদা অস্তিত্ব তখন ছিল না। অর্থাৎ শিশুরা ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের ছোট সংস্করণ মাত্র। তাদেরও কাজ করতে হতো বড়দের মতো; খারাপ কিছু করলে শাস্তিও পেত সেই বড়দেরই মতো । শিশুরা যে বড়দের ছোট সংস্করণ নয়, অর্থাৎ শুধু আকৃতিতেই যে তারা ভিন্ন নয়, বরং পরিপক্বতা, বুদ্ধিমত্তা, আচার-আচরণ, মানসিকতা সর্বোপরি বোঝার ক্ষমতা যে তাদের ভিন্ন—মানবসভ্যতায় এ উপলব্ধি হয়েছে খুব বেশি দিন আগে নয়। এখন কম বয়সী কাউকে দিয়ে কাজ করালে সেটাকে আমরা শিশুশ্রম বলি। এটা একটা গর্হিত কাজ বলে মনে করি। শিশুশ্রম প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার নিরিখে শিশুশ্রমের পক্ষে যুক্তি দাঁড় না করিয়ে তাদের দারিদ্র্য ও দুরবস্থা নিরসনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিশ্চয়ই বহুলাংশে শ্রেয়।
একইভাবে শিশুদের অপরাধ প্রবণতাটা বেড়েছে। কিন্তু এ বাস্তবতার দোহাই দিয়ে শিশুদের বয়স কমিয়ে তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শাস্তির ব্যবস্থা করার যৌক্তিকতা দাঁড় করানোটা আমাদের সব ধরনের মূল্যবোধের পরিপন্থী। এ ধরনের সাংঘাতিক যুক্তির ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে হয়তো অন্তত কিছু শিশুকে দারিদ্র্যের অজুহাতে পূর্ণাঙ্গ শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোর আরও ভয়ংকর যুক্তি আমাদের কশাঘাত করতে পারে।
অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। শাস্তিতে কাজও হয়। অন্যরাও শাস্তির ভয়ে অপরাধ করা থেকে বিরত হবে। কিন্তু অপরাধ দমনে শাস্তিই যখন একমাত্র বা মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে যায়, তখন সমাজে অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা, নির্মমতা ও বর্বরতা বৃদ্ধি পায় কয়েক গুণ।
আমাদের সমস্যাটা আরও গভীর। আমরা ক্রমেই শাস্তি এবং আরও ভয়ংকর শাস্তিনির্ভর একটা সমাজে পরিণত হচ্ছি। অপরাধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে আমরা ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তির প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। বহু জায়গায়, অর্থাৎ ঘরের আড্ডায়, ছোটখাটো আলোচনা থেকে বড় রাজনৈতিক অঙ্গনে, টক শোতে, টেলিভিশনে এবং পত্রপত্রিকায় একটা আক্ষেপ শোনা যায়—অপরাধের পর বিচার বিলম্বিত হয়, সহজে দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি হয় না, ফলে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটন করা থেকে নিবৃত হয় না। কথাটা যদি সর্বাঙ্গে সত্যি হতো, তাহলে যেসব দেশে অপরাধের দ্রুত বিচার হয় এবং শাস্তিও নিশ্চিত করা হয়, সেসব দেশে অপরাধ অনেক কম হতো। কিন্তু এর কোনো বাস্তবভিত্তিক প্রমাণ তো চোখে পড়ে না।
উদাহরণ দেব শুধু একটা দেশেরই। সেই দেশটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। আমাদের দ্বিগুণ। সেই দেশে গত চার-পাঁচ বছরে গড়ে কারাগারে বন্দী অপরাধীর সংখ্যা ওঠানামা করে প্রতিবছর ২০, ২১ ও ২২ লাখের মধ্যে। বলে রাখা ভালো, সেই মুল্লুকে হাজতি আসামি নেই বললেই চলে। কোনো অভিযুক্তকে পুলিশ পাকড়াও
করার পর থানায় নিয়ে আদর–আপ্যায়নসহ (আসলেই) জেরা করে, বিভিন্ন ধরনের ফিরিস্তি তৈরি করে তারপর তাকে বলে, ‘আচ্ছা, এখন যাও, তিন, চার অথবা পাঁচ মাস পর আদালতে তোমার বিচার শুরু হবে। আইনজীবীর সঙ্গে সলাপরামর্শ করো, বিচার শুরু হলে আদালতে হাজিরা দিতে হবে।’ অল্প কিছু সাংঘাতিকভাবে ভয়ংকর অভিযুক্ত ছাড়া প্রায় কাউকেই বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে জেলে পুরে রাখা হয় না।
বিচার শেষে দোষী সাব্যস্ত হলে সেই দোষী অপরাধীকে বলা হয়, ‘আচ্ছা, এখন বাসায় যাও, এক মাস পরে তোমার শাস্তি নিরূপণের জন্য আরেকটা শুনানি হবে।’ সেই শুনানিতে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়ে
বিচারক আবার তাকে দুই-তিন সপ্তাহ সময় দেন সব প্রস্তুতি নিয়ে কারাগারে হাজির হওয়ার দিন ধার্য করে। অর্থাৎ যে ২১ লাখ লোক আজকে কারাগারে আছে, তাদের প্রায় সবাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কারাগারে প্রবেশ করেছে। বিচার হয়েছে, শাস্তি হয়েছে, কারাবাস হয়েছে—সবকিছুই হয়েছে, কিন্তু দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি অপরাধ হয় যুক্তরাষ্ট্রেই।
বড় দাগে আমাদের কারাগারগুলোতে আজকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাবন্দীর সংখ্যা ৩০ হাজার। হাজতি আসামি, অর্থাৎ যাদের ধরা হয়েছে, তদন্ত চলছে অথবা বিচার শুরু হয়েছে, তাদের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার। আমাদের থেকে দ্বিগুণ জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধী প্রমাণিত হয়ে কারাবন্দীর সংখ্যা প্রায় ৩০ গুণের কাছাকাছি। আমেরিকায় অপরাধ কমেনি। আমাদের ৮০ হাজার কয়েদির পরিবর্তে আমরা যদি আমাদের কারাগারগুলোয় আগামী সপ্তাহে ১০ লাখ বন্দী দিয়ে ভরে ফেলি, তাহলে এ দেশে অপরাধ কমবে না। যেমনটি কমেনি যুক্তরাষ্ট্রে।
জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে কারাবন্দীর সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, রুয়ান্ডা, তুর্কমেনিস্তান, এল-সালভাদর ও কিউবা। কিন্তু এসব দেশ সংঘটিত অপরাধের সংখ্যায়ও প্রায় শীর্ষে।
অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। শাস্তিতে কাজও হয়। অন্যরাও শাস্তির ভয়ে অপরাধ করা থেকে বিরত হবে। কিন্তু অপরাধ দমনে শাস্তিই যখন একমাত্র বা মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে যায়, তখন সমাজে অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা, নির্মমতা ও বর্বরতা বৃদ্ধি পায় কয়েক গুণ। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে যে সমাজে গণতন্ত্র যত কম, সেই সব সমাজেই জনগণ ঝুঁকে পড়ে শাস্তির দিকে। আমাদের গণতন্ত্র কমছে, আর তাই বাড়ছে কঠোর শাস্তির চাহিদা।
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক