যোগাযোগ, বাণিজ্য, অবকাঠামো ও রপ্তানি উন্নয়নে চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত অংশীজন। তবে কোনো অংশীদারত্ব যাতে একক নির্ভরতার ঝুঁকি তৈরি না করে, সেই ভারসাম্য তৈরি করাও টেকসই উন্নয়নের শর্ত।
যোগাযোগ, বাণিজ্য, অবকাঠামো ও রপ্তানি উন্নয়নে চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত অংশীজন। তবে কোনো অংশীদারত্ব যাতে একক নির্ভরতার ঝুঁকি তৈরি না করে, সেই ভারসাম্য তৈরি করাও টেকসই উন্নয়নের শর্ত।

বাংলাদেশে চীনের ফুটপ্রিন্ট কতটা গভীর

বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেখা গেছে। কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ, কোনোটার কাজ এখনো চলছে। এসব প্রকল্পের অনেকগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত চীন। তেমন কিছু প্রকল্প হলো, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল (ঢাকা-মাওয়া-যশোর), কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, দাসেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনকেন্দ্র।

এ ছাড়া আরও আছে ফোর টায়ার ডেটা সেন্টার, শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও ডিজিটাল সরকার প্রকল্প, মোবাইল অপারেটরের একচেটিয়া নেটওয়ার্ক ভেন্ডর, গোয়েন্দা সংস্থার আড়ি পাতা বা সিটিজেন সার্ভেইলেন্সে এনটিএমসির ইন্টিগ্রেটেড এলআইসি (লফুল ইন্টারসেপ্ট), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নজরদারি সফটওয়্যার, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র।

৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঠিকাদারি কাজ ও বছরে ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি নিয়ে বাংলাদেশে চীন তার পদচ্ছাপ (ফুটপ্রিন্ট) সুগভীর করে ফেলেছে।

পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেললাইন—এমন কিছু প্রকল্পকে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্প হিসেবে দাবি করে।  

এর বাইরে তাদের পরিকল্পিত অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প ১১টি। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনা, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশন পর্যন্ত রেললাইনকে মিটারগেজ থেকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, ডিজিটাল কানেকটিভিটি স্থাপন ও পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ প্রকল্প। এই ১১ প্রকল্পে চীন থেকে ৫০২ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলোর কাজ এখনো শুরু হয়নি (২১ নভেম্বর ২০২৩, প্রথম আলো)।

রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাস্তব সংখ্যা কখনো পুরোপুরি স্বীকার করে না চীন। আরাকান সংকট সমাধান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের প্রায় প্রতিটি প্রস্তাবে চীন বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে চীনের অনুদানও নগণ্য। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে সংযুক্ত করতে চীনের অনীহা প্রত্যাবাসনকে বিলম্বিত করছে বলেও অভিযোগ আছে।

বাংলাদেশে চীনের এসব পদক্ষেপের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব উপেক্ষা করা আগামী দিনে মুশকিল হয়ে যাবে। চীনের প্রভাবের একটা বাহ্যিক তাৎপর্য হচ্ছে গণতন্ত্রের সংকটে থাকা বাংলাদেশের ক্ষমতাকাঠামোয় বড় একটি বৈশ্বিক শক্তির শক্তিশালী বহিঃসমর্থন থেকে যাওয়া।

সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ ও জলবায়ু ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে পারবে না। বাংলাদেশের স্বার্থের শিবির হিসেবে আমাদের সবাইকে দরকার। তবে সম্পর্ক হতে হবে উইন-উইন এবং কোনো বিশেষ দলের বদলে জনগণের সঙ্গে এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস না করে।

অন্যদিকে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে স্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে ভারত আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর একটি দেশের পক্ষে এ রকম একাধিক শক্তিশালী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাবের ভার বহন করা কঠিন। বাংলাদেশে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক এটা নিজের স্বার্থেই তারা চাইবে না। কেননা, তাতে প্রতিযোগিতাহীন ঠিকাদারি, ঋণ ও রপ্তানি প্রকল্প এবং বাজার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।  

বাংলাদেশে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান থাকলে এবং প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র হলে চীন বাংলাদেশের ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঠিকাদারি কাজ পেত কিনা তা এক বড় প্রশ্ন। এখানে অপরাপর এশীয়, ইউরোপীয় ও আমেরিকান দেশগুলো ভাগ বসাত। অর্থাৎ প্রতিযোগিতা তৈরি হতো। মূল্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের ডলার সাশ্রয় হতে পারত।

চীনের নজর শুধু অর্থনীতি ও বাণিজ্যে, তারা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না—এ বয়ান থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। ২০২০ সালের পর থেকে আফ্রিকার সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশেই পশ্চিমারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। প্রতিটি দেশে চীন ও রাশিয়ার মদদে সেনাবাহিনী পশ্চিমা সমর্থনপ্রাপ্ত সরকারগুলোকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে এই শক্তি বাংলাদেশেও পশ্চিমের রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে দিতে নীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

চীনের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশকে ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এ ঋণ এখনো সচল হয়নি। তবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। তবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল সচল রাখার প্রশ্নে পশ্চিমারা চীন থেকে কাঁচামাল আমদানিতে কোনো বাধা দেবে না।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গত ১২ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮-২২ সময়ে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ২৫তম। এ সময়ে দেশের মোট আমদানির ৭৪ শতাংশ চীন থেকে হয়েছে (১৩ মার্চ ২০২৩, নিউএজ)।

অর্থাৎ শুধু ফিনিশড পণ্য, মূলধনি যন্ত্র (ক্যাপিটাল মেশিনারি) ও কাঁচামাল নয়, বরং শীর্ষ অস্ত্র আমদানির উৎসও হয়ে উঠেছে চীন, যার ধারেকাছেও কেউ নেই। একক দেশকেন্দ্রিক এ ধরনের সামরিক ও বেসামরিক আমদানি-নির্ভরতার সমস্যা কৌশলগত ও সরবরাহ শৃঙ্খলগত—দুই দিক থেকেই আছে। একক উৎস থেকেই এত অধিক হারে অস্ত্র কেনা কতটা কৌশলগত ও টেকসই, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

তবে চীনের ঋণে উচ্চ সুদের কথা বলা হলেও সেটা ততটা সত্য নয়। বরং চীনের ঋণ মূলত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট ধরনের। এখানে অর্থ, কারিগরি সহায়তা, নকশা, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ প্রায় সবকিছুই (৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ) চীন থেকে আনার বাধ্যবাধকতা থাকে। ফলে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ থাকে না।

চীনা ঋণ প্রকল্পের সুদের হার ২ শতাংশের মতো, যা অপরাপর ঋণ প্রকল্পের মতোই কিংবা কিছু ক্ষেত্রে কিছু কম। কিন্তু চীনের প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে হয় না বলে প্রকল্পের খরচ অনেক বেশি হয়। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), জাইকা, বিশ্বব্যাংকের ঋণের মতোই চীনা প্রকল্পে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকে। তবে চীনের ঋণ আনুমানিক ১৫ বছরে পরিশোধ করার শর্ত থাকে, যেখানে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান ঋণ পরিশোধে ৩০ বছর পর্যন্ত সময় দেয়। অর্থাৎ চীনের ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে হয়, তাই কিস্তি প্রতি জমার পরিমাণ বেশি।

আমদানির উৎস বহুমুখী হওয়া একদিকে যেমন টেকসই, অন্যদিকে কিছু সময় প্রতিযোগিতামূলক আমদানি বাজার সাশ্রয়ীও। পাশাপাশি করোনাকালে যে বৈশ্বিক শিক্ষা নেওয়া হয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে উৎপাদন ও সরবরাহশৃঙ্খল এক দেশনির্ভর না করে বহুমুখীকরণ করা। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী এবং চীন-ভারতনির্ভর আমদানিদর্শনের কোথায় কোথায় নতুন বিন্যাস আনা ও আমদানি বৈচিত্র্যমুখী করা যায়, তা নিয়ে বিশদ সমীক্ষা করা দরকার।  

যোগাযোগ, বাণিজ্য, অবকাঠামো ও রপ্তানি উন্নয়নে চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত অংশীজন। তবে কোনো অংশীদারত্ব যাতে একক নির্ভরতার ঝুঁকি তৈরি না করে, সেই ভারসাম্য তৈরি করাও টেকসই উন্নয়নের শর্ত।

সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ ও জলবায়ু ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে পারবে না। বাংলাদেশের স্বার্থের শিবির হিসেবে আমাদের সবাইকে দরকার। তবে সম্পর্ক হতে হবে উইন-উইন এবং কোনো বিশেষ দলের বদলে জনগণের সঙ্গে এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস না করে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক
faiz.taiyeb@gmail.com