যোগাযোগ, কর্মসংস্থান আর শিক্ষায় কতটা এগোলো রংপুর?

গতবার, মানে ৯ বছর আগে রংপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে গিয়েছিলেন, রংপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। প্রতিটি বিভাগে একাধিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু রংপুর বিভাগে একটিও নেই।

দিনাজপুর শহরকে স্থানীয় লোকজন বলছেন, বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। শহরজুড়ে খালি গেট আর গেট। গ্যাস আসার কথা ছিল দিনাজপুরে, আসেনি। পঞ্চগড় জেলায় বেশ কিছু আন্তনগর ট্রেন গেছে রেলমন্ত্রী ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রীর সুবাদে। লালমনিরহাটে অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি শুরু হয়েছে। গত ১৫ বছরে রংপুর বিভাগের প্রাপ্তি বলতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, তিস্তা সড়ক–সেতু, দ্বিতীয় তিস্তা সেতু, সোনাহাট স্থলবন্দর।

২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামে এসেছিলেন। প্রতিশ্রুতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেন, ইপিজেডের আর নদ-নদী খননের। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস নামে একটি আন্তনগর এসেছে, তবে আসন বরাদ্দ রংপুরের অর্ধেক। রংপুরের তিনটি স্টেশনে স্টপেজ আর কুড়িগ্রামে একটিতে। বার্থ, স্নিগ্ধা আর শোভনেই যাত্রীরা উঠতে পারেন। সুলভের কোচই নেই। সবচেয়ে গরিব জেলার যাত্রীরা দামি কোচে চলাচল করেন। নেই পণ্য পরিবহনের কোচও। ফলে ট্রাকই ভরসা। যমুনা সেতুর কারণে আবার অধিক পণ্য বহনও করা যায় না। অন্যদিকে এরশাদ সরকারের পতনের আগপর্যন্ত চিলমারী রুটে চারটি লোকাল ট্রেন চলাচল করত। ভোর ৪টায়, সকাল ১০টায়, বেলা ১টায় ও রাত ১০টায় ট্রেনগুলো লালমনিরহাট, সান্তাহার, পার্বতীপুর ও চিলাহাটি চলত। ফেরি চলত চিলমারী থেকে দেওয়ানগঞ্জ।

বিল পাস হয়েছে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিল পাসের এত বছরেও ক্লাস শুরুর নামগন্ধ নেই। শুনলাম, কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলে আপাতত ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু সেটাও আর পরে হলো না।

চিলমারীতে মেরিন একাডেমির জায়গা নির্বাচন করা শেষ হয়েছে সেই কবে। সেই ফাইল এখন কোথায় গেছে, কেউ জানে না। সেই ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল যে চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতু, তার কাজও শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে? বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কথা ছিল, কিন্তু...।

আর ইপিজেড? তা ওই ঘোষণা পর্যন্তই। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন  কর্মসংস্থান, তার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। ছোট উৎপাদনব্যবস্থায় উৎপাদকদের হাতে থাকে প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি স্থানীয়ভাবেই সারিয়ে নেওয়া যায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্থানীয় জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের বিকল্প নেই। বাংলা যখন বিশ্বে শিল্পে নেতৃত্ব দিয়েছে, তখন তা ছিল স্থানীয় জ্ঞান, দক্ষতা, কাঁচামাল প্রযুক্তি ও বাজারনির্ভর। ১৬৫০ থেকে ১৭৫০-এর মধ্যে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বাংলা থেকে ১০ লাখ গজ থেকে ১০ কোটি গজ কাপড় রপ্তানি করে। এই বিপুল উৎপাদন বাংলা সামাল দিয়েছিল বড় কারখানা করে নয়, করেছিল কাজ ও চাষ বাড়িয়ে, কাজের মানুষ ও দক্ষতা বাড়িয়ে। ফলে যতক্ষণ না উৎপাদন শেষ হয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছাত, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই পণ্যগুলো কারিগরদের নিজের বলে বিবেচিত হতো। কারণ, তাঁতিদের তাঁত, সুতা, শ্রম, দক্ষতা ও প্রযুক্তি—সবই তাঁর।

কুড়িগ্রামে কর্মসংস্থানের জন্য এ বিষয়টি ফিরিয়ে আনা যেত। কারখানানির্ভর পাটের বদলে তুলার আবাদ (একসময় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বিখ্যাত ভোগা তুলার চাষ হতো। উলিপুরের দুর্গাপুর বিখ্যাত ছিল কাপড়ের ব্যবসার জন্য।)  চালু করা যেত। কারণ, তুলা থেকে সুতা আর সুতা থেকে কাপড়—পুরো পর্বটাই কারিগরদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমাদের তাঁতিরা যে সুতার উচ্চ মূল্যের কারণে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন ঘটনা উল্টে যেত। এর ফলে প্রতি ঘরে কর্মসংস্থান তৈরি হতো।

ছোট নদ-নদীগুলো খনন করা হয়েছে। বুড়ি তিস্তা, ঘাঘট, শ্যামাসুন্দরী, চণ্ডীজনসহ কয়েকটির খনন হয়েছে। হারানো নদ-নদীগুলো আবার ফিরেছে কিছুটা। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য ধন্যবাদ পাবেন।

সড়কপথে মুক্তাঞ্চল রৌমারী থেকে ঢাকা সরাসরি যাওয়া যায়। গ্যাসও আসতে পারে কম দূরত্বেই। চাইলেই ইপিজেড করা যায়। কাঁচ শিল্পের কাঁচামাল কোয়ার্টজ সিলিকার পুরো জোগান ব্রহ্মপুত্রে আছে, এমনটাই জানিয়েছে জয়পুরহাটের খনিজ গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

তারপর এসেছিলেন চিলমারীতেও—২০১৭ সালে। চিলমারী বন্দর চালু হওয়ার ঘোষণার পরপরই তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান উদ্বোধনও করেছেন। বাল্কহেডে কদিন পাথর ও কয়লা আমদানি হলো। কিন্তু ফেরি চালুর কথাও ছিল গেল ঈদে। মুখ্য সচিব বন্দর পরিদর্শনও করলেন। পদ্মা সেতুর কয়েকটা ফেরি আনার কথাও কাগজে-কলমে পাস হলো। এখন পর্যন্ত পন্টুনই এল না। অথচ এই ফেরি চালু হলেই যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে যেত। ফেরি ও পন্টুন সবই তো সদরঘাটে পড়ে আছে, সেগুলো আনলেই হয়ে যায়। এইটুকু কাজও আটকে আছে।

চিলমারীতে মেরিন একাডেমির জায়গা নির্বাচন করা শেষ হয়েছে সেই কবে। সেই ফাইল এখন কোথায় গেছে, কেউ জানে না। সেই ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল যে চিলমারী-হরিপুর তিস্তা সেতু, তার কাজও শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে? বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কথা ছিল, কিন্তু...।

১৫ বছর! ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়া ছিল গরিবতম দেশ আর ১৫ বছর পর ১৯৩৩ সালে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়। ত্রিশের দশকের মহামন্দা সারা দুনিয়া নাকাল হলেও তাদের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। ১৫ বছর মানে দুটি প্রজন্ম।

যোগাযোগ, কর্মসংস্থান আর শিক্ষা—কোথায় এগোলো রংপুর? চালের জোগানদার রংপুর, তার তিস্তার পানি, সে-ও পেলাম না।

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge1@gmail.com