বিমানবন্দরের কেচ্ছা ও বাঙালির চরিত্র

খানিকটা দীর্ঘ সময় পর দেশে গিয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করলাম। বিশেষত মেট্রোরেলে চড়ে কিছু সময় চোখ বন্ধ করে রেখে মনে হলো উড়োজাহাজে বসে আছি। এর আরাম নিউইয়র্ক মেট্রোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মেট্রোর সেবাদাতা জনবল ঢাকা বিমানবন্দরের সেবা ও ‘উৎপাতদাতা’ কর্মীবাহিনীর চেয়েও উন্নত।

পদ্মা সেতু ও মেট্রোর পর সরকার এবার পাতালরেলে হাত দিয়েছে। এতে পাতালরেলের বিরোধিতাকারী অনেক বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টার বদনরাজি কিঞ্চিৎ বিবর্ণ হয়ে গেছে। এই নির্মাণধারা অব্যাহত থাকলে আমরা একদিন আধুনিক বাংলাদেশ পাব। কিন্তু বিপত্তি সাধবে বিমানবন্দরের সেবা খাত। এর অস্থিমজ্জায় যে অনাধুনিকতা ও অহেতুক অত্যাচারের আবহমান বাঙালি চরিত্র প্রোথিত রয়েছে, তার চিকিৎসা কে করবে?

বিমানবন্দর গাবতলীর আকাশ সংস্করণমাত্র। এখানে ৩২টা সংস্থার ঠাসাঠাসি থাকা সত্যিই কি প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে? উন্নত দেশে বিমানবন্দরের টার্মিনালগুলো প্রাইভেট খাতে দিয়ে দেওয়া হয়।

সরকারের দায়িত্ব থাকে মূলত তিনটি সংস্থার মাধ্যমে—ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও সিকিউরিটি। ঢাকা বিমানবন্দরে ঢুকলে বোঝা যায় এখানে যাত্রীর চেয়ে অন্য লোকজন বেশি; যেন গাছের চেয়ে বিচি বড়। এর সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। এত বাড়তি মানুষের পদে পদে নজরদারি ও সাহায্য করার নামে চিপায় ফেলে টাকা আদায় করার ঘুষযজ্ঞে উৎসবমুখর এই বন্দর—বাঙালি চরিত্রের বীরত্বগাথা—দুর্বল ও দরিদ্রের ওপর নিপীড়ন।

বাংলাদেশে আসতে গেলে প্রবাসী ও বিদেশিদের একটা ফরম পূরণ করতে হয়। পৃথিবীর আধুনিক কোনো দেশে এর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, পাসপোর্টের তথ্য ও ছবি ইমিগ্রেশনের কাছে থাকে। দেশে গিয়ে কোথায় থাকবে, তার ঠিকানা লিখতে হয়। এটা হাস্যকর দুই কারণে। এক, শয়তান লোক মিথ্যা ঠিকানা দেবে। দুই, সৎ লোক কী লিখবে তা নিয়ে বিপদে পড়ে। আমি আদরযত্নের কারণে বাপের বাড়ির চেয়ে শ্বশুরবাড়িতে বেশি সময় কাটাই। কিন্তু ফরমে শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা লিখতে লজ্জা লাগে। পাছে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমাকে ঘরজামাই ভেবে বসেন। এমনিতেই এনারা মুখ গোমড়া করে থাকেন।

ইমিগ্রেশন শেষ করে আবার লম্বা লাইন, যা জিইয়ে রাখা হয়েছে। ফাইনাল চেকিং শুরু করেনি। কারণ, করলে যাত্রীদের সুবিধা হয়ে যাবে। এয়ারপোর্টের বীর বাঙালিরা বুঝিয়ে দেবেন, অত্যাচার কত প্রকার ও কী কী। সব শেষ করে যখন প্লেনে ওঠার ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি, তখন রাত সাড়ে আটটা। অর্থাৎ মোট তিন ঘণ্টার কসরত করে তবে তো মুক্তি। এই দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ঢাকা বিমানবন্দরে পোহাতে হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এর দ্বিতীয় নজির আছে বলে আমার জানা নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজটি বিমানবন্দর থেকেই শুরু করতে হবে।

নিউইয়র্ক ফেরার পথে ঢাকা থেকে দোহা আসার ফ্লাইট ছিল রাত নয়টায়। বিকেল চারটায় বাসা থেকে রওনা দিলাম। ভাগ্যগুণে সোয়া পাঁচটায় পৌঁছে গেলাম। সেদিন কোনো ভিভিআইপি রাস্তা আটকে দিয়ে রাজপথে কাউকে ‘ডিম সেদ্ধ’ করেননি বলে ধন্যবাদ জানাই। এয়ারপোর্টের বিল্ডিংয়ে পৌঁছানোর আগেই একজন পুলিশ সদস্য গাড়ি থামিয়ে তাকিয়ে দেখলেন আমাদের গাড়িতে কোনো ‘খারাপ’ লোক আছে কি না। জমিজমা বেচে যাঁরা শ্রমিক হয়ে প্রবাসে যান, তাঁদের গাড়িতে পরিবার-পরিজন একটু বেশিই থাকে। এটা আমাদের বন্ধনের সংস্কৃতি। কিন্তু তাঁদের আটকে রাখা হচ্ছে।

এরপর বহির্গমনের ওপরতলায় গাড়ি উঠে গেল। কোন গেটে থামতে হবে, বোঝা কঠিন। ছোট্ট একটা বিল্ডিংয়ে দুটি টার্মিনাল। বড়ই অদ্ভুত! কোথাও এমনটি দেখিনি। ভাগ্যের ওপর ভর করে একটা গেটে থামতে হবে। কারণ, পিছিয়ে আসা যাবে না। এই গেটগুলোতে কৃত্রিমভাবে লম্বা লাইনের জট পাকিয়ে রাখা হয়। শীতের মাঝরাতে সে এক কঠিন যন্ত্রণা। গরমেও যন্ত্রণা। এই প্রথম ধাক্কাতেই বোঝা যায় এটি বিশ্বের ‘মোস্ট আনওয়েলকামিং এয়ারপোর্ট’।

যাত্রীরা বিমানবন্দরের অতিথি। প্রথমে তাদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে হয়। এরা কোনো হাজতের আসামি নয় যে তাদের লাগেজ চেক করার অজুহাতে সবাইকে দরজার বাইরে লম্বা লাইনে ঘণ্টাখানেক দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে।

লাগেজ টানার কার্ট এনে দিয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেবে—এমন প্রস্তাব আসতে থাকল চারদিক থেকে। হেনস্তা থেকে উদ্ধার পেতে কয়েকজন ঘুষ দিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। এ যেন এক ত্রাস সৃষ্টির ফন্দি। গেটের বাইরে দাঁড়ানো কনস্টেবল আমার পাসপোর্ট নিয়ে বার কয়েক ছবির সঙ্গে মেলাতে থাকলেন। বিদেশে এ কাজটি বোর্ডিং পাস দেওয়ার সময় করা হয়।

স্ক্যানার দিয়ে আমার দুটি লাগেজ চলে গেল। যখন স্ক্যানারের অপর পাশ থেকে লাগেজ সংগ্রহ করতে গেলাম, দুজন স্ক্যানারম্যান আমাকে আঙুলের ইশারায় ডাকলেন—‘কী, হারমোনিয়াম নিচ্ছেন বুঝি?’ কথা শুনে মনে হলো লোকটা অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী। লাগেজ না খুলেই দিব্যদৃষ্টি দিয়ে লাগেজের ভেতরে দেখে ফেলেছেন। কথার সুরে আরও মনে হলো যেন কোনো গোপন মারণাস্ত্র পেঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এবার প্রশ্ন, ‘নাম কী?’ তাঁর কাছে আমাকে নাম বলতে হবে কেন, বুঝতে পারলাম না। তবু নাম বলা শেষ না করতেই ওই ‘বিজ্ঞানী’ মন্তব্য করলেন, ‘ইন্ডিয়া যাচ্ছেন বুঝি!’

বিমানবন্দরে ঢোকার আগে আমি সাধারণ মাত্রার চেয়ে একটু বেশি প্রেশারের ওষুধ সেবন করে থাকি, যেন মস্তিষ্ক মাত্রাতিরিক্ত শীতল থাকে। তাই রক্ষা। এবার আরও লম্বা লাইন বোর্ডিং পাসের জন্য। মাত্র চারটা কাউন্টারে পাস দেওয়া হচ্ছে নিবু নিবু আলোয় অনুচ্চ এক ছাদের নিচে। এত নিষ্প্রভ ও মুমূর্ষু কাউন্টারের চেহারা পৃথিবীর আর কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। দু-একজন টাউট প্রকৃতির লোক এসে ৫০০ টাকা দিলে আমাকে লম্বা লাইনের সামনে নিয়ে যাবে বলে প্রস্তাব দিল। ধীরগতির কাউন্টার এদের স্বার্থেই কাজ করে।

পাশেই দেখলাম তথ্য ও সেবার নতুন কাউন্টার করা হয়েছে। সেখানে লেখা আছে, যেন তথ্য ও সেবার বিনিময়ে আমরা কোনো ঘুষ না দিই। এই নতুন সংযোজন দেখে একদিকে আনন্দিত হলাম। অন্যদিকে লজ্জাও পেলাম। কারণ, ইংরেজিতেও সে কথা লেখা ছিল। ‘ঘুষ দেবেন না’—এ-জাতীয় বাণী পৃথিবীর কোনো বিমানবন্দরে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।

ঘণ্টাখানেক কচ্ছপগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পর আরেকটা কাউন্টার পেলাম। ভদ্রলোকের কাজ পাসপোর্ট দেখে একটা নতুন কাগজে সিল মারা। এই নবসংযোজন কিসের প্রয়োজনে, বোঝা গেল না। কোনো দিন এই বাহুল্যের সাক্ষাৎ পাইনি। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ করণিক কাগুজে ভেজাল কমিয়ে আনে। কিন্তু এ দেশের বাঙালি যে কেরানিতন্ত্রের ভক্ত, তা এয়ারপোর্টে না ঢুকলে বোঝা যাবে না। এবার বোর্ডিং পাসের কর্মকর্তা আমার ফোন নম্বর রেখে দিলেন। আমি আপত্তি না করে দিলাম। কারণ, একবার তাঁরা আমাকে বিমানে ঢোকার আগমুহূর্তে ফোন করে ডেকেছিলেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ভয়ে জড়সড়।

বিশেষ পুলিশি পাহারায় আমি লাগেজ স্ক্যানিং রুমে ঢুকলাম। আমার দুর্বল চেহারার সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের সন্দেহের মিল খুঁজে পেলেন না। ওনারা আমার লাগেজের ভেতরে একটি কালো বোমাসদৃশ কী একটা দেখালেন। আমিও ভয় পেলাম। কিন্তু আমার ব্যাগ আমাকেই খুলতে হলো। বেরিয়ে এল এক জোড়া করতালসদৃশ মন্দিরা। আমি বাজিয়ে দেখালাম।

ওনারা আশ্বস্ত হয়ে আমাকে আবার পুলিশি পাহারায় বিমানের গেটের কাছে এনে জালালি কবুতরের মতো ছেড়ে দিলেন। ততক্ষণে আমার স্ত্রী মূর্ছাপ্রায় অবস্থা থেকে জ্ঞান পেল। এ যেন সতীর পুণ্যে পতির উদ্ধার। বলা বাহুল্য, এই স্ক্যানিং প্রথমেই একবার করা হয়েছিল।

ইমিগ্রেশন শেষ করে আবার লম্বা লাইন, যা জিইয়ে রাখা হয়েছে। ফাইনাল চেকিং শুরু করেনি। কারণ, করলে যাত্রীদের সুবিধা হয়ে যাবে। এয়ারপোর্টের বীর বাঙালিরা বুঝিয়ে দেবেন, অত্যাচার কত প্রকার ও কী কী। সব শেষ করে যখন প্লেনে ওঠার ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি, তখন রাত সাড়ে আটটা। অর্থাৎ মোট তিন ঘণ্টার কসরত করে তবে তো মুক্তি। এই দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ঢাকা বিমানবন্দরে পোহাতে হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এর দ্বিতীয় নজির আছে বলে আমার জানা নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজটি বিমানবন্দর থেকেই শুরু করতে হবে।

  • বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অর্থনীতির অধ্যাপক