মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কি নিরপেক্ষ হতে পারবেন

দেড় যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। এই সুবাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষকদের সম্মান করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের¯স্নেহ করেন। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে থাকে।

শিক্ষকদের অনেকেই যেমন তাঁদের দায়দায়িত্বের যথাযথ জায়গায় থাকেন না। আবার অনেক শিক্ষার্থী যথাযথ দায়িত্ব এবং ভূমিকা না রেখে অন্যায় ও অপকর্মে যুক্ত হন। এবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরে বেশ কিছু শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর ঘটনা ঘটেছে। ইতিপূর্বে এভাবে ঢালাও পদত্যাগের নজির আমরা কেউই দেখিনি।

তবে এবার যেসব শিক্ষককে পদত্যাগ করতে জোর করা হয়েছে বা পদত্যাগ করানো হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই নিজেদের নৈতিক অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিলেন—এমন অভিযোগেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি দেখা গেছে, সেটি হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষকের আচরণ, নৈতিকতা এবং একাডেমিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোনো ক্ষেত্রে বেশ কিছু সত্য ঘটনা সাধারণদের কাছে উন্মোচন করা হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছু ঘটনাও দেখা গেছে।

বিগত ১৫ বছরে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের দ্বারা অসংখ্য নিরীহ এবং সৎ শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে কর্মরত শিক্ষকেরা মুখ বুজে সহ্য করেছেন নির্যাতন।

প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি শিক্ষকেরা অন্ততপক্ষে মেধার ভিত্তিতে ছাত্রদের আবাসিক হলে আসন বরাদ্দের মতো ন্যায্য কাজটিও করতে পারেননি। আবার এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং ন্যায্য কাজ করতে না পারার পরিবেশ বা চাটুকারিতা নিজেরাই তৈরি করেছেন। কারণ, ১৫ বছরে আমি শুনিনি দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক-কর্মকর্তাকে চাকরিও দিতে পারেননি।

দলীয় ক্যাডার শিক্ষক এবং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ হয়েছে অনেক। যে উপাচার্যকে যোগদানের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে ফুলের মালা বা ডালা দিয়ে বরণ করা হয়েছে, সেই একই উপাচার্যের বিদায়ের সময় দেখা গেছে পাঁচজন ব্যক্তিও তাঁর পাশে নেই। এমনকি এমন ফুলের মালাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেরই মৃত্যুবরণের পর জানাজার সময়ও খুব কম লোককেই দেখা গেছে।

বেশ কয়েক বছর আগে ক্লাসে উপস্থিতি না থাকায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে ছাত্রলীগের নেতারা রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটরে অধ্যক্ষকে পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। এমন লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় আমি তখন মোটেও অবাক হইনি। কারণ, শিক্ষক লাঞ্চনার ঘটনা তখন প্রায়ই ঘটতে দেখতাম। কিন্তু ওই সব নির্যাতনকারী শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শাস্তি হতে দেখেছি খুব কমই। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কর্তৃক পুরস্কৃত হতে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে আমি নিজে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।

বেশ কয়েক বছর আগে আমার বিভাগেরই স্নাতকোত্তর পরীক্ষার কক্ষে আমরা দুজন শিক্ষক দায়িত্বরত ছিলাম। এ সময় একজন (ছাত্রলীগ নেতা) পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার কক্ষে মুঠোফোনে কথা বলতে না দেওয়ায় ওই পরীক্ষার্থী অন্য সব পরীক্ষার্থীর সামনেই আমাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে।

পরীক্ষার কক্ষে সংঘটিত আচরণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমি একটি প্রতিবেদন পাঠাই। এরপর ‘ডিসিপ্লিন কমিটি’র সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ওই শিক্ষার্থীকে পরবর্তী আরও দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। পরপর তিন বছর পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারলে অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী তার ছাত্রত্ব থাকে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী এবং কতিপয় শিক্ষক তদবির করলে, তা আমলে নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষার কক্ষে শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা ওই শিক্ষার্থীর শাস্তি কমিয়ে তাকে পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, একজন শিক্ষার্থীœস্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তির পর তিনটি একাডেমিক সেশনের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করতে হবে। এর অর্থ পরিষ্কার যে তিনটি একাডেমিক সেশনের পর কোনোভাবেই তিনি আর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। অথচ ওই শিক্ষার্থী শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসদাচরণের পরও পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিতে তার শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হয়। লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী কর্তৃক অধ্যক্ষ লাঞ্ছিত হবেন, শিক্ষক লাঞ্ছিত হবেন—এমন বিষয়ে উদ্বেগ কিংবা উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু ছিল না। এটি খুব ন্যায্য ও স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।

ইতিপূর্বে দেখেছি, দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে শিক্ষকেরা যাঁরা প্রশাসনের পদে গিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের মনমতো যা ইচ্ছা তা–ই করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মতো অভিযোগ স্পষ্টভাবে থাকা সত্ত্বেও দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ওই সব প্রশাসনিক পদধারী শিক্ষক কোনো শাস্তির আওতায় আসেননি। এখনো শঙ্কা রয়েছে যে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কি না। বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেন কিংবা নারী কেলেঙ্কারির মতো ভয়াবহ অনৈতিকতার যেসব অভিযোগ আমাদের সামনে এসেছে, সেগুলোর কি যথাযথ তদন্ত ও বিচার প্রত্যাশা করতে পারি?

বাংলাদেশে যাঁদের নীতি-নৈতিকতায় সমস্যা রয়েছে, তাঁরাই যেকোনোভাবে শক্তিশালী। এবারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও আমরা সেটি লক্ষ করেছি। অনেকেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে এখন নিরপেক্ষ সেজে পদ ছাড়েননি কিংবা পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ১২ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমরা সবাই যোগ্য মানুষ চাচ্ছি, তবে যোগ্য মানুষটি আমার দলের হতে হবে। অনেকে আবার নিরপেক্ষ চাচ্ছেন। তবে নিরপেক্ষটি একটু আমার পক্ষে হতে হবে। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা সময়।’ তাঁর এই বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে যে অনেকেই নিরপেক্ষ সাজছেন পদ নেওয়ার জন্য। আবার নিরপেক্ষতার ভাঁজে পক্ষপাতিত্বও খুঁজছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো অনেকেই আছেন, যাঁরা বিগত সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেই পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। আবার এখন বিভিন্ন অজুহাতে রাতারাতি দলীয় নিরপেক্ষ হয়েছেন। অথচ তাঁরাই লেজুড়বৃত্তির ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কাছে মাথা নত করে পদ বাগিয়ে নিয়ে গোটা পরিবেশকে কলুষিত করতে কার্পণ্য করেননি। এখন তাহলে কীভাবে তাঁদের কাছে ভালো কিছু আসা করতে পারি! সুযোগ পেলে যেমন তাঁরা নিরপেক্ষ সাজেন, আবার তাঁরাই পদ আঁকড়ে থাকার জন্য অন্যায়কে সমর্থন করেছেন। তাহলে কি তাঁরা আর অন্যায় করবেন না?

  • ড. সুলতান মাহমুদ অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।