ভারতের জনগণ সম্পদ নাকি বোঝা

জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি দেশের জন্য একই সঙ্গে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী চার দশকে ভারতের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৭০ কোটি হবে।
ছবি : রয়টার্স

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি এবং প্রথমবারের মতো জি–২০ সভাপতির পদ পাওয়ার বিষয়টি উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে ভারত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ একটি বছরের সমাপ্তি টানতে যাচ্ছে। তবে দেশটির সামনে আরেকটি মাইলফলক উঁকি দিচ্ছে।

সেটি হলো জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল জনসংখ্যার দিক থেকে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে এবং বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তবে গত তিন দশকে ভারত মুগ্ধ করার মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও দেশটিকে তার ১৪০ কোটি মানুষের খাদ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, যা চীনের ক্ষেত্রে হচ্ছে না।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি দেশের জন্য একই সঙ্গে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী চার দশকে ভারতের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৭০ কোটি হবে। যদিও ২১০০ সাল নাগাদ তা আবার ১১০ কোটিতে নেমে আসবে।

তবে ভারতের রাজ্যগুলোর জনসংখ্যাগত অসম ধরন বা আদলকে যদি আমলে নেওয়া না হয়, তাহলে দেশটির জনসংখ্যাগত সুবিধা বা লাভ উল্টো একটি স্থায়ী জনসংখ্যাগত বিভক্তি বা লোকসানে পরিণত হতে পারে। উত্তরের রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও দক্ষিণ ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি ইতিমধ্যে স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। দক্ষিণের রাজ্য কেরালা এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্য নাগাল্যান্ডে জনসংখ্যা ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাসের প্রবণতা সম্পর্কে অনুমান করাকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলছে। দেশটি ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, খরা এবং বন্যার মতো চরমভাবাপন্ন জলবায়ুঘটিত দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতার মুখে পড়েছে। দেশটির কিছু নদীর পানি উপচে পড়ছে আবার কিছু নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। উপমহাদেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যে পানির সংকটে ভুগছে। পানির অভাবে পড়ে অনেক এলাকা বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়ায় সেখান থেকে লোকজন অন্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এটি আঞ্চলিক বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

এ প্রবণতার রাজনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। ১৯৪৭ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল ৩৫ কোটি। ১৯৯৭ সালে সেই সংখ্যা ১০০ কোটির ওপরে চলে আসে। মূলত দরিদ্র, স্বল্প শিক্ষিত হিন্দিভাষী অধ্যুষিত উত্তরের রাজ্যগুলো এ জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো উন্নত মানবসম্পদ ও শিক্ষানীতি অনুসরণ করার মাধ্যমে অধিকতর কার্যকরভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করেছে।

ভারতের চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভরসার কারণ হতে পারে এবং ভারতীয়রা কঠিন সময়ে নিজেদের স্থিতিস্থাপক হিসেবে প্রমাণ করেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের সামনে যে সুযোগ আসছে, তা কাজে লাগাতে ভারতকে অবশ্যই এই প্রবণতাগুলোকে আমলে নিতে হবে। এক রাজ্যে লোকসংখ্যা অনেক বেশি হারে বাড়ছে, অন্য রাজ্যে কম হারে বাড়ছে—এই বাস্তবতা মাথায় নিয়ে সব রাজ্যের লোকসংখ্যায় সমন্বয় আনতে হবে, নচেৎ এই জনসম্পদ ভারতের জন্য অনেক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে কয়েক দশক ধরে প্রতি পরিবারে ছয়–সাতটি সন্তান ছিল, দক্ষিণ ভারতে প্রতি পরিবারে সন্তানের সংখ্যা দুটিতে নেমে এসেছে।

ভারত যেহেতু একটি গণতন্ত্রের দেশ, তাই অধিক জনসংখ্যার কথা বিবেচনায় নিয়ে উত্তরে আরও বেশি সংসদীয় আসন থাকা উচিত ছিল, অর্থাৎ তাদের হাতেই অধিকতর রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব ঠিক রাখার সিদ্ধান্ত দেন।

সাংবিধানিক সংশোধনী অনুযায়ী, সেই স্থিতাবস্থার মেয়াদ ২৫ বছর পরে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী এটিকে আরও সিকি শতাব্দীর জন্য নবায়ন করেছিলেন।

ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণের কিছু পার্লামেন্ট সদস্য ২০ লাখের কম ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন। অথচ উত্তর থেকে কিছু পার্লামেন্ট সদস্য প্রায় ২৯ লাখ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন বিজেপি হিন্দিভাষী গোবলয় হিসেবে পরিচিত উত্তর প্রদেশের ভোটারদের অপ্রতিরোধ্য সমর্থন অর্জন করেছে। দলটি এখন এ অসংগতির অবসান ঘটাতে চায় এবং ২০২৬ সালে সংশোধনী বাতিল হয়ে গেলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব ঠিক করার বিষয়টি পুনরায় চালু করবে বলে ঠিক করেছে।

যদিও এটি করা হলে তা ভারতীয় সংসদকে আরও প্রতিনিধিত্বমূলক করে তুলবে। তবে এটি উত্তরের রাজ্যগুলোকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও দেবে, যা বিজেপিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতামতের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছেমতো সংবিধান সংশোধন করতে সক্ষম করে তুলবে।

আজ বিহার ও উত্তর প্রদেশ—মাত্র এই দুটি উত্তরের রাজ্য ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সিংহভাগ দায়ী। ২২ কোটি লোকের আবাসস্থল উত্তর প্রদেশ যদি একটি স্বাধীন দেশ হতো, তাহলে সেটি হতো জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম জনবহুল দেশ। এই রাজ্যগুলোর ভারতীয় রাজনীতিতে অসম প্রভাব রয়েছে।

অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো ইতিমধ্যে নিজেদের বদলে দিয়েছে। উত্তরে নারীদের মধ্যে সাক্ষরতা জ্ঞান যেখানে জাতীয় গড় থেকে অনেক নিচে, সেখানে দক্ষিণে নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা স্তর অনেক উঁচুতে, যার বদৌলতে এখানে জনসংখ্যা অনেক কম।

যেখানে বিহারের জনসংখ্যা ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে একই সময়ে কেরালার জনসংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

এদিকে ভারতের শ্রমবাজার মহামারি থেকে নিজেকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়া বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার জাতীয়ভাবে ২৩ শতাংশ বেড়েছে। কেরালা ও কাশ্মীরে ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণও গত কয়েক বছরে তা কমে গেছে।

ভারতের চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভরসার কারণ হতে পারে এবং ভারতীয়রা কঠিন সময়ে নিজেদের স্থিতিস্থাপক হিসেবে প্রমাণ করেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের সামনে যে সুযোগ আসছে, তা কাজে লাগাতে ভারতকে অবশ্যই এই প্রবণতাগুলোকে আমলে নিতে হবে। এক রাজ্যে লোকসংখ্যা অনেক বেশি হারে বাড়ছে, অন্য রাজ্যে কম হারে বাড়ছে—এই বাস্তবতা মাথায় নিয়ে সব রাজ্যের লোকসংখ্যায় সমন্বয় আনতে হবে, নচেৎ এই জনসম্পদ ভারতের জন্য অনেক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। বর্তমানে তিনি ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি