মাতৃত্ব মহান, মায়েদের অসীম শক্তি, মায়েরা সব পারেন—এ রকম কথা শুনে বড় হয়েছি আমরা সবাই। বিষয়গুলো অনেকটা ধ্রুব সত্যের মতোই, যুগে যুগেই এর প্রমাণও দিয়ে এসেছেন নারীরা।
বিপরীতে আমরা শুনে এসেছি, প্রত্যেক নারী প্রাকৃতিকভাবেই মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকলেও একজন পুরুষকে বাবা হয়ে উঠতে হয়। আর সেই বাবা হয়ে ওঠাটা ‘মা’ হওয়ার চেয়েও কঠিন।
গবেষণা বলে, স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে পুরুষও সন্তানের সঙ্গে পিতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপনে হরমোনের সহযোগিতা পায়। অর্থাৎ শুধু মাতৃত্ব নয়, পিতৃত্বও সহজাত। মায়ের মতোই, একজন বাবাকেও যেতে হয় গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, একজন পুরুষ যখন পিতা হন, তখন তাঁর শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। টেস্টোস্টেরন হচ্ছে সেই হরমোন, যাকে সাধারণভাবে যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়।
পৌরুষের প্রতীক হিসেবে যে শৌর্যবীর্যের কথা বলা হয়ে থাকে, তার পেছনেও রয়েছে এই টেস্টোস্টেরন হরমোনের কারসাজি। শরীরে এই হরমোনের উচ্চমাত্রা পুরুষকে আগ্রাসী করে তোলে।
মজার ব্যাপার হলো, পুরুষ যখন সন্তানের পিতা হন, তখন এই হরমোন কমে যাওয়ার কারণেই তিনি সন্তানের প্রতি স্নেহশীল হয়ে ওঠেন, ধৈর্যও বেড়ে যায়। এমনকি সন্তান জন্মের পর টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে, পুরুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। শিশুর জন্য অপত্যস্নেহ তো থাকেই, তার অমঙ্গলের আশঙ্কায় মায়ের মতোই উদ্বিগ্ন থাকেন পিতাও।
একই সঙ্গে টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার ফলে ডোপামিন ও অক্সিটোসিন নামের দুই রাসায়নিকের প্রভাব বেড়ে যায় শরীরে। বলা বাহুল্য, এই দুটি রাসায়নিকের সঙ্গেও সরাসরি ভালোবাসার অনুভূতির যোগ রয়েছে।
শিশুসন্তানকে জড়িয়ে ধরলে বা তাদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটালে অক্সিটোসিন আর ডোপামিন উৎপন্ন হয় শরীরে, যা মানুষকে চাঙা করে, ভালো লাগার অনুভূতি দেয়। শিশুর মধুর হাসি দেখে একজন পিতারও তাই মায়ের মতোই মন গলে যায়। সন্তানের মুখ দেখে সারা দিনের সব ক্লান্তি মিলিয়ে যায়।
এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটি কিন্তু একজন নারীরই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী আনা মাশিন পিতৃত্বের ওপর অনেক দিন ধরেই কাজ করে আসছেন। তাঁর দ্য লাইফ অব ড্যাড: দ্য মেকিং অব দ্য মডার্ন ফাদার বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে সন্তানের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটানোর মাধ্যমে একজন পুরুষ শিশুর মানসগঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
একদম ছোট বাচ্চা কোলে নিতে পারেন না বলে থাকেন অনেক পুরুষই। আনা জানান, তাদের সেই ভয় কাটাতে, শিশুর সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠতে ৬ থেকে ১৮ মাস পর্যন্তও সময় লাগতে পারে। ‘প্রথম প্রথম মনে হতে পারে শিশু বোধ হয় আপনাকে পছন্দ করে না, আপনি কোলে নিলেই কাঁদতে শুরু করে, কিন্তু এর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে।’
মায়ের শরীরে যেমন সন্তান জন্মের পর থেকেই অক্সিটোসিন বেড়ে যায়, পিতার ক্ষেত্রে তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। দেখা গেছে শিশুকে কোলে নিলে, তার সঙ্গে খেলাধুলা করলে, ছড়া কিংবা গান শোনালে এই বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এর জন্য, বাবাদের শিশুসন্তানের প্রতি আরও মনোযোগী হতে বলেন আনা।
শিশুর অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টার পাশাপাশি, নিজের মধ্যে হরমোনের পরিবর্তনগুলো লক্ষ করলে আর সেই অনুযায়ী মানসিক প্রস্তুতি নিলে যা সহজেই করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
যেসব মায়ে চাকরি করেন, সন্তানের জন্য দুধ বের করে রেখে যান, সেই দুধ যদি বাবা নিজে খাওয়ান বা শিশু যখন শক্ত খাবার খেতে শুরু করে তখন তাকে খাবার খাওয়ান, শিশু পরিচর্যার কাজে অংশ নেন তখনো অক্সিটোসিন বাড়ে। আর এটা শুধু পিতার শরীরে না, শিশুর শরীরেও।
তবে এখানেও কিন্তু একটা অদ্ভুত বিষয় আছে। মা-বাবা দুজনের সঙ্গে সময় কাটালেই শিশুর শরীরে অক্সিটোসিন নিঃসরণ হয়, তবে বাবার ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে বেশি বাড়ে যখন তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করে। সে জন্যই মায়ের তুলনায় বাবার সঙ্গেই বেশি খেলায় মাততে ভালোবাসে শিশুরা।
গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়েছে, একজন পুরুষ যখন বাবা হন, তখন তাঁর বহির্মুখী স্বভাব পাল্টে যায়। বাইরের জগৎ ছেড়ে তিনিও তখন পরিবারকেই বেশি সময় দিতে চান। আবার সন্তান জন্মদানের পরে যখন কোনো মা বিষণ্নতায় ভোগেন, তখন তাঁর প্রভাবে একই ধরনের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন তাঁর পুরুষ সঙ্গীও।
পিতৃত্ব নিয়ে আনা মাশিনের এক দশকের বেশি সময়ের গবেষণায় এমন প্রমাণও মিলেছে, যেসব পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেশি, শিশু কান্নাকাটি করলে তাঁরা বিরক্ত হন। আর যাঁদের শরীরে কম, তাঁরা হন উদ্বিগ্ন, কীভাবে শিশুর কান্না থামানো যায়, সেদিকেই বেশি মনোযোগী হন তাঁরা।
শুধু কি হরমোন? সন্তানের জন্ম হলে পিতার মস্তিষ্কের গঠনেও পরিবর্তন আসে। যদিও তা নারীর মস্তিষ্কের গঠনের পরিবর্তনের মতো নয়। শিশুর চাহিদা বোঝা এবং তা পূরণের জন্য নারীর মস্তিষ্কের মধ্যভাগে নানা পরিবর্তন আসে, যা শিশুর পরিচর্যা, ভালোবাসা আর ঝুঁকি শনাক্তে সহায়ক হয়।
আর পুরুষের এই পরিবর্তন আসে মস্তিষ্কের বহিরংশে, যা শিশুর সামাজিক উন্নয়ন আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক। আর শিশুর সঠিক বিকাশে এই দুইয়েরই আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়েছে, একজন পুরুষ যখন বাবা হন, তখন তাঁর বহির্মুখী স্বভাব পাল্টে যায়। বাইরের জগৎ ছেড়ে তিনিও তখন পরিবারকেই বেশি সময় দিতে চান। আবার সন্তান জন্মদানের পরে যখন কোনো মা বিষণ্নতায় ভোগেন, তখন তাঁর প্রভাবে একই ধরনের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন তাঁর পুরুষ সঙ্গীও।
এখন তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন পুরুষের এই সহজাত প্রবৃত্তির বিষয়ে আমরা সচেতন নই? কেন মাত্র অল্প কদিন ধরে এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে সেই চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোতেই।
পুরুষকে যেখানে তাঁর স্বাভাবিক অনুভূতি প্রকাশেই বাধা দিয়ে আসা হয়েছে যুগ যুগ ধরে; সেখানে মায়ের মতো কোমল ভালোবাসা বোঝার বা তার চর্চা করার সুযোগ কোথায়?
তবে এখন সময় এসেছে পুরুষের তার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার, সহজাত পিতৃত্বের প্রতি সুবিচার করার। শুরু থেকেই মায়ের পাশে থেকে নবজাত শিশুকে পরিচর্যা করা, সন্তান বাৎসল্যের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার। এর জন্য সমাজমানস ও রাষ্ট্রীয় নীতিরও পরিবর্তন জরুরি।
নারী-পুরুষের সমান অধিকারের আলাপ এখন পুরোনো হয়ে গেলেও এখনো অল্প কয়েক দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটিই ঠিকমতো পান না পুরুষ। এ কথা আমরা কবে বুঝতে শিখব, সন্তান লালন-পালন কেবল মায়ের কাজ না, পিতাকেও শিশুর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ করে দিতে হবে, করে নিতে হবে?
নাদিয়া সারওয়াত উন্নয়নকর্মী, জেন্ডার ফোকাল, এমআরডিআই
nadiasarwat@gmail.com