খাদ্য অপচয়ের সমস্যাটি মূলত উন্নত দেশের সমস্যা। কিন্তু জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থার (ইউএনইপি) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ বেশি। ইউএনইপির প্রতিবেদনে খাদ্য অপচয় নিয়ে কেন এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কে লিখেছেন গোলাম রসুল
বাংলাদেশের গৃহস্থালির অতিরিক্ত খাদ্য অপচয়ের তথ্যটি আসলে ভিত্তিহীন ও বাস্তবতা বিবর্জিত।
খাদ্য অপচয়ের জন্য প্রয়োজন জনগণকে সচেতন করা এবং তাদের আচরণে পরিবর্তন আনা।
খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপ, খাদ্য সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অত্যাবশ্যকীয় হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বে এখনো প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধা-অনাহারে ভুগছে। খাদ্যের অভাবে অপুষ্টি ও নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। এরপরও সেই খাবার অপচয় হচ্ছে।
গত মার্চ মাসের ২৭ তারিখে জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা (ইউএনইপি) বিশ্বের খাদ্য অপচয়-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতে্যক মানুষ গড়ে বছরে গৃহস্থালিতে ৭৯ কেজি খাবার অপচয় বা নষ্ট করে। এই অপচয়ের হার বাংলাদেশে ৮২ কেজি। এটা পৃথিবীর উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
সংবাদটি অনেককেই বিস্মিত করেছে। কারণ, যে দেশে এখনো অনেক মানুষ তিন বেলা পেট ভরে খেতে পায় না, একটু সস্তায় খাবার কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিসিবির ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় থাকে, গ্রামের মানুষ বাড়ির আশপাশ থেকে শাক, লতা-পাতা কুড়িয়ে এনে খায়—সে দেশের মানুষের পক্ষে গৃহস্থালিতে খাবার নষ্ট করা একটি বিলাসিতা।
গরিব মানুষের পক্ষে সত্যিই এ রকম বিলাসিতা করার সুযোগ আছে কি না, এটা চিন্তাভাবনা করে দেখার বিষয়। সংবাদটি বাংলাদেশে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছে।
খাবার অপচয় কেবল সম্পদেরই অপচয় নয়, এর সঙ্গে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য জড়িত। অপচয়কৃত খাবার এবং সৃষ্ট বর্জ্য পরিবেশের দারুণ ক্ষতি করছে। ইউএনইপির এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্যের অপচয় থেকে বিশ্বব্যাপী ৮ থেকে ১০ ভাগ ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাস নির্গমন হয়। এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ খাদ্য অপচয়ের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও পরিবেশদূষণ করছে।
এর ফলে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন করে দুটি ‘অপবাদ’ যোগ হলো। ‘খাবার অপচয়কারী’ এবং ‘পরিবেশদূষণকারী’। এই ‘অপবাদ’ দুটি মেনে নেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে দেখার প্রয়োজন, ইউএনইপির তথ্য কতটুকু সত্য, কীভাবে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, কীভাবে খাদ্য অপচয় পরিমাপ করা হয়েছে।
এসব বিষয় অনুধাবনের জন্য আমাদের প্রথমেই দেখতে হবে ‘ফুড ওয়েস্ট’ বা খাদ্যের অপচয় বলতে কী বোঝায়। খাদ্য হলো এমন বস্তু, যা মানুষের খাওয়ার জন্য নিরাপদ, পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং খাওয়ার উপযোগী। এটা সরাসরি বা প্রক্রিয়াজাত করে অথবা অর্ধপ্রক্রিয়াজাত করে খাওয়া যেতে পারে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন, সব খাদ্যদ্রব্যের সব অংশই মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়, বা নিরাপদ ও সুস্বাদু নয়। যেমন নারকেল, কাঁঠাল, বেল, আনারস, আম, কলা, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি ফলের ভেতরের অংশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হলেও এর বাইরের অংশ সরাসরি মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়। একইভাবে জীবজন্তুর হাড়, চামড়া, রক্ত ইত্যাদি সরাসরি মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়। এটি ধর্ম, বর্ণ ও পরিবেশ ভেদে ভিন্ন হতে পারে। যেমন আমরা জীবজন্তুর রক্ত খাই না। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশে এটা উপাদেয় খাবার।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্যের দুটি অংশ থাকে, ভোগের উপযোগী এবং ভোগের অনুপযোগী। খাদ্য প্রস্তুত বা প্রক্রিয়া করার সময় খাদ্যের অনুপযোগী অংশ আলাদা করা হয় বা বাদ দেওয়া হয়, যেটাকে আমরা ‘কিচেন ওয়েস্ট’ বা রান্নাঘরের বর্জ্য বলে থাকি।
এখন আমাদের দেখতে হবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কীভাবে খাদ্যের অপচয়কে সংজ্ঞায়িত করেছে বা পরিমাপ করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সুন্দরভাবে খাদ্যের অপচয় (ফুড ওয়েস্ট) এবং খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি (ফুড লস)—দুটি জিনিসকে ব্যাখ্যা করেছে।
সংস্থাটির মতে, খাদ্যের অপচয় বলতে বোঝায় মানুষের ভোগের উপযোগী খাদ্যসামগ্রী যখন ভোক্তা না খেয়ে সেটা ফেলে দেয় বা নষ্ট করে। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিতরণ বা বিপণনব্যবস্থায় খাদ্যের যে ঘাটতি বা ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেটাকে খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি বলা হয়।
জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) মত অনুসারে, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী নষ্ট করা বা ফেলে দেওয়া অথবা খাদ্যসামগ্রী মানুষের খাদ্যের পরিবর্তে অন্য বিকল্প কাজে লাগানো, যেমন হাঁস-মুরগি-গবাদিপশুর খাবার, মাছের খাবার তৈরি করা, জৈবসার বানানো ইত্যাদি হলো খাদ্যের অপচয়।
অন্যদিকে খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি বলতে বোঝায়, খাদ্যের পরিমাণ ও গুণগত মান হ্রাস পাওয়া। খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে ফসল উত্তোলনের পর সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিতরণব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই।
এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) খাদ্যের অপচয়কে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাদের মতে, বাসাবাড়ি, দোকান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা থেকে যেসব খাদ্যসামগ্রী ‘ল্যান্ডফিল’ বা ভাগাড়ে পরিত্যাগ করা হয়, তাই খাদ্যের অপচয়। এফএওর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সংস্থাটি বলেছে, খাদ্যসামগ্রীর বিকল্প ব্যবহার, যেমন খাদ্য থেকে জৈবজ্বালানি, জৈবসার বানানো বা অন্যান্য উৎপাদনশীল ব্যবহার খাদ্যের অপচয় নয়।
ওপরের বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করে এটা প্রতীয়মান হয় যে খাদ্যের অপচয় হলো সেসব খাদ্যবস্তু, যা মানুষের খাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় এবং খাওয়ার উপযোগী। কিন্তু ভোক্তাপর্যায়ে যেমন গৃহস্থালি বা কিছু খাদ্য সেবা প্রদানকারী পরিষেবার মাধ্যমে তা নষ্ট হয় বা ফেলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ফসল উত্তোলন–পরবর্তী পর্যায়ে খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিতরণব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রীর পরিমাণ বা গুণাগুণের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেটাকে খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি বা ‘ফুড লস’ বলে।
খাদ্যসামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতি এবং খাদ্যসামগ্রীর অপচয়ের কারণগুলো আলাদা। এই অপচয়গুলো খাদ্য সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে হয়ে থাকে। যেমন খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি হয় ফসল উত্তোলন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণ পর্যায়ে। অন্যদিকে খাদ্য অপচয় হয় ভোক্তাপর্যায়ে, মূলত ভোক্তা এবং খাদ্য সেবাপ্রদানকারী পরিষেবাগুলো এর সঙ্গে জড়িত।
এই দুই সমস্যার সমাধানের পদক্ষেপ ও পন্থাও আলাদা। যেমন খাদ্য অপচয়ের জন্য প্রয়োজন জনগণকে সচেতন করা এবং তাদের আচরণে পরিবর্তন আনা। অন্যদিকে খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ, খাদ্য সংরক্ষণব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবহন ও বিতরণব্যবস্থার উন্নয়নে অধিকতর বিনিয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি।
খাদ্য অপচয়ের সংজ্ঞার পর, আমরা এবার এই প্রতিবেদনে খাদ্য অপচয়ের পরিমাপের দিকে নজর দিই। এই প্রতিবেদনে কোনো প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি বরং চট্টগ্রাম শহর এবং খুলনা শহরের কিছু পুরোনো তথ্যের ভিত্তিতে খাদ্য অপচয়ের পরিমাপ করা হয়েছে।
প্রকৃত অর্থে, খুলনার তথ্যাদি কোনো গবেষণা থেকে আসেনি, এসেছে খুলনা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহের তথ্য থেকে। চট্টগ্রাম শহরের গবেষণা দুটি করা হয়েছিল গৃহস্থালির উৎপাদিত বর্জ্য পরিমাপের জন্য। এর একটিতে ৫০টি পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। অন্যটিতে ৭০টি পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই গবেষণা দুটিতে খাদ্য অপচয় পরিমাপের কোনো সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়নি এবং সেটি তাদের উদ্দেশ্যও ছিল না। অথচ এই দুটি গবেষণার গড় ব্যবহার করে এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু খাদ্যের অপচয়ের পরিমাপ করা হয়েছে।
মাত্র ১২০টি পরিবারের বর্জ্যের তথ্যের ভিত্তিতে (যা আবার খাদ্য অপচয়ের পরিমাপের উদ্দেশ্যে নয়) সারা দেশের খাদ্যের অপচয় পরিমাপ করা হয়েছে। এটা এই প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে এই প্রতিবেদনে রান্নাঘরের বর্জ্যকে খাবার অপচয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের গবেষণার জন্য এটা কোনোভাবেই সঠিক পদ্ধতি নয়। আমাদের পূর্বের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে রান্নাঘরের বর্জ্য খাদ্যদ্রব্যের অনুপযোগী অংশ। এটাকে মোটেও খাদ্যদ্রব্যের অপচয় বলা যায় না। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে মানুষ কালেভদ্রে রেস্তোরাঁ বা বাইরে খেতে যায় এবং অধিকাংশ সময় ঘরে তৈরি করা খাবার খেয়ে থাকে, সেখানে রান্নাঘরের বর্জ্য বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং এর সঙ্গে খাবার অপচয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের গৃহস্থালির অতিরিক্ত খাদ্য অপচয়ের তথ্যটি আসলে ভিত্তিহীন এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। এই ভুল তথ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের ওপর একটি অসত্য অপবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটার নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত তাৎপর্য রয়েছে।
আমরা আশা করি ইউএনইপি তাদের প্রতিবেদনের দুর্বলতা, তথ্যের ঘাটতি, খাদ্য অপচয় পরিমাপের দুর্বলতা বুঝতে পারবে। এর পাশাপাশি তারা তাদের প্রতিবেদনের দুর্বলতা তুলে ধরে বাংলাদেশিদের খাদ্য অপচয়কারীর অপবাদ থেকে মুক্তি দেবে।
আসল সত্য হলো, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বড় সমস্যা হচ্ছে খাদ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পর্যাপ্ত অবকাঠামোর এবং জ্ঞানের অভাব। এর ফলে প্রতিবছর প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি, দুধ, মাছ, মাংসের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এফএওর ২০১৯
সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ফলমূল এবং শাকসবজির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি।
খাদ্য অপচয়ের সমস্যাটি মূলত উন্নত দেশের সমস্যা। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রাচুর্যের সমস্যা। আশা করি, এই ভুল তথ্যের কারণে সরকারের নীতিনির্ধারণে এবং অগ্রাধিকার নির্ণয়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি রোধে সরকার খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ এবং বাজারব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি করবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
●গোলাম রসুল অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা