শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দলের প্রায় সব নেতা-কর্মী কেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন? এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই আন্দাজ পাওয়া যাবে দলটির দেউলিয়াত্বের মাত্রা। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রত্যেক সদস্য ও সমর্থক গোষ্ঠী—শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী—কতটা অর্বাচীন হলে ধরে নিতে পারেন, তাঁদের এ ক্ষমতা অনন্তকাল স্থায়ী হবে। আর যদি তা ধরে না নিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁরা কীভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকতে পারেন?
বলা বাহুল্য, তাঁরা দুর্নীতি করেছেন বলেই অদৃশ্য হয়ে গেছেন। একটি বক্তৃতা রাখা তো দূরের কথা, প্রকাশ্যেই আসতে সাহস করছেন না তাঁরা। কারণ, প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেই দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হবে এবং তাঁরা গ্রেপ্তার হবেন।
কতটা দেউলিয়া হলে দলের তৃতীয় সারির একজন নেতাও নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা দিয়ে রাজনীতির মাঠে দাঁড়িয়ে দলকে সংগঠিত করতে পারেন না। কর্মীদের অভয় দিয়ে ধীরে ধীরে দলটিকে গোছাতে শুরু করতে পারেন—এমন একজন নেতা বা আওয়ামী বুদ্ধিজীবী নেই। আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বের আরেকটি দিক হলো নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের অন্তঃসারশূন্যতা।
একাত্তরে গণহত্যার দোসর জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির এ দেশে রাজনীতি করতে পারবে আর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ পারবে না, যারা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে? এ রকম যুক্তিপূর্ণ ভাষায় কথা বলে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁদের পক্ষে জনমত গঠন করার মতো বুদ্ধিমান ও সৎ কোনো লোক আওয়ামী লীগে একটিও নেই এখন।
এরশাদের পতনের পর যখন জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতা জেলে, তখন মিজান চৌধুরী দলের নেতৃত্ব দিয়ে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদে ৩৫টি আসন পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে অফিসে বসতে দেয়নি, মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি এবং নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে ব্যাপক ধরপাকড়, জেল-জুলুম করেছে। তা সত্ত্বেও বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী দলের কার্যালয়ে থেকে প্রতিদিন বক্তৃতা-বিবৃতি-সমালোচনা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের কেউ কোথাও নেই। তাদের লন্ডভন্ড দলীয় কার্যালয় এখন ছিন্নমূল মানুষের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সবচেয়ে সুবিধাভোগী তাঁর আত্মীয়ের মধ্যে প্রায় ৪০ জন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁদের অহমিকা, নৃশংসতা ও দুর্নীতির মাত্রা রূপকথাকেও হার মানায়। শেখ হাসিনা ফুফাতো ভাইয়ের ছেলেকে সংসদ সদস্যের চেয়েও বেশি টাকা মারার সুযোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা উত্তরের মেয়র করেছেন। সেই লোক পতন আঁচ করতে পেরে দুই দিন আগেই সিঙ্গাপুর হয়ে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। হাসিনার আত্মীয়রা প্রায় সবাই নিরাপদে দেশ ছাড়তে পেরেছেন। এর মানে হলো, সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি তাঁদের ছিল।
শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁর কিছু সফলতা ছিল, দুর্নীতির মাত্রা কম ছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রদের বিল উপস্থাপন করেন। একটা সময় ছিল, শেখ হাসিনার গণতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে প্রেসিডেন্ট করেছিলেন তিনি এবং একই সংসদে ডেপুটি স্পিকার পদটি বিএনপিকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য ‘ঘনিষ্ঠজনদের’ পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে আসেন।
২০০৯ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার স্বেচ্ছাচারিতার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে শেয়ারবাজার ও আর্থিক খাত ধ্বংসের প্রধান কারিগর হিসেবে বিবেচিত সালমান এফ রহমানকে তিনি বানিয়েছেন উপদেষ্টা। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ঘরানার, অথচ তিনি অর্থমন্ত্রী করেন সব সময় একজন আমলা বা ব্যবসায়ীকে।
তাঁর পতনের পর খবর বেরিয়েছে, ‘সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিদেশে ৬২০টি বাড়ি, আরও বিপুল সম্পত্তির খোঁজ’। এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠির দুর্নীতি, আইজিপি বেনজীরের দুর্নীতিসহ সবই হাসিনার শুধু জ্ঞাতসারেই নয়, তাঁর প্রত্যক্ষ মদদে হয়েছে। বিনিময়ে তিনি চেয়েছিলেন তাঁর দলের প্রতি আনুগত্য এবং পার্টি তহবিলে বড় অঙ্কের চাঁদা। এসব তো এখনা জানা কথা এবং সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু।
গণতন্ত্রহীনতায় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে, দেখা দেয় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। তখন সরকারের টিকে থাকার জন্য দরকার হয় সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশ, ব্যবসায়ী শ্রেণির সমর্থন। এ সমর্থন মেলে অন্যায় রাষ্ট্রীয় সুবিধার বিনিময়ে। শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, তিনি সামরিক-বেসামরিক আমলার, পুলিশের, ব্যবসায়ী শ্রেণির ক্ষমতা, অর্থ, সমর্থন দ্বারা সুরক্ষিত। কিন্তু তা হয়নি। তাসের ঘরের মতো উড়ে গেছে তাঁর মসনদ।
আওয়ামী লীগের সব নেতার মুখে যখন অতিকথন ও দম্ভের প্রকাশ, তখন বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ অন্য নেতাদের মধ্যে দেখা যায় পরিপক্বতার ছাপ। হাসিনা সরকারের পতনের পর নেতা-কর্মীদের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশ প্রদান, ধর্ম যার যার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার এবং প্রতিহিংসার পথ পরিহার, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার তারেক রহমানের বুদ্ধিমত্তা ও পরিপক্বতার সাক্ষ্য দেয়।
আওয়ামী লীগের সব নেতার মুখে যখন অতিকথন ও দম্ভের প্রকাশ, তখন বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ অন্য নেতাদের মধ্যে দেখা যায় পরিপক্বতার ছাপ। তাঁরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন জাতীয় সরকার গঠনের কথা। বলছেন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পরিকল্পনার কথা। ‘আমাকে দেশনায়ক-রাষ্ট্রনায়ক সম্বোধন করবেন না’, ‘আমার জন্মদিনের কেক কাটবেন না’, ‘প্রধানমন্ত্রীও স্বেচ্ছাচারী হবেন না, এটা নিশ্চিত করতে চাই’, ‘ভোটের অধিকার নিশ্চিত হলে কোনো দল নিষিদ্ধ করার দায়ভার রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে না’, ‘একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান থাকবেন না’, ‘এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না’।
হাসিনা সরকারের পতনের পর নেতা-কর্মীদের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশ প্রদান, ধর্ম যার যার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার এবং প্রতিহিংসার পথ পরিহার, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার তারেক রহমানের বুদ্ধিমত্তা ও পরিপক্বতার সাক্ষ্য দেয়।
অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে বিএনপির প্রধান দুই নেতা—মহাসচিব মির্জা ফখরুল, মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তার মধ্যেও পরিপক্ব রাজনীতিজ্ঞানের পরিচয় মেলে; যেমন ‘রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করলে অনাবশ্যক রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি হবে’, ‘আমরা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই’ ইত্যাদি। ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এলে আমাদের আপত্তি নেই’ অথবা ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি নামানো ঠিক হয়নি’—১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের হাতে সীমাহীন জেল-জুলুম-নির্যাতনের পরও তাঁরা যখন এসব কথা বলেন, তখন তাঁরা উঠে যান অন্য এক উচ্চতায়, যা আওয়ামী লীগের যেকোনো নেতার নাগালের বাইরে।
কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তারেক রহমানের অতীতের কর্মকাণ্ডের ও কথাবার্তার যে রেকর্ড, তাতে তিনি যে এসব বক্তব্যের সঙ্গে আন্তরিক, তা মানুষের পক্ষে আস্থায় আনা কঠিন। তিনি ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি হিসেবে তিনি শাস্তিপ্রাপ্ত। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর মা, খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্টে জন্মদিন পালন নিয়েও ছিল সমালোচনা ও বিতর্ক। তাঁকে আস্থায় নেওয়ার আগে মানুষের এসব বিষয় মনে পড়বে।
উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, তারেক রহমানকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ‘ক্লেপ্টোক্রেটিক সরকারের’ প্রতিভূ হিসেবে চিত্রিত করেছেন, তাঁকে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে একই মনোভাব কানাডার ও ভারতেরও।
কিন্তু কেউ যদি নিজেকে পরিবর্তন করে একজন মহৎ মানুষে উন্নীত হতে চান, সমাজের উচিত তাঁকে সুযোগ দেওয়া। আদি মহাকাব্য রামায়ণের রচয়িতা বাল্মিকী প্রথম জীবনের ছিলেন রত্নাকর দস্যু। কিন্তু প্রথম জীবনে তিনি কী ছিলেন, তা কেউ মনে রাখেনি। মনে রেখেছে একজন অমর স্রষ্টা হিসেবে বাল্মিকীকে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নেতা-কর্মীরা স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে গর্ব করতে চান। কোন তারিখে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটা বড় কথা নয়। গর্ব করার মানে হলো, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মূল্যবান মনে করেন। তাঁদের নেতা জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবকে স্বাধীনতাসংগ্রামের মহান নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা হিসেবে গণ্য করতেন। কখনো অসম্মান করে কথা বলেননি।
একটি আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে নির্মাণ করতে হয়, বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই জানেন। তবু তাঁদের গভীর মনোযোগ দিয়ে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস পাঠ করতে অনুরোধ করব। একটি আধুনিক রাষ্ট্র মানেই একটি প্রজাতন্ত্র, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষ তৈরি করবে রাষ্ট্রের সব বিধিবিধান। রাষ্ট্র একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রপঞ্চ, অতএব এর কোনো ধর্ম থাকবে না, রাষ্ট্র হবে সব ধর্মের সব মানুষের।
বিএনপির নেতৃত্ব যদি একটি আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাদের পতাকাতলে হাজির হতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তারা যদি মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে উগ্র মতাদর্শের শক্তিকে লালন করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম সৃষ্টি করে, তাদের অবস্থাও আওয়ামী লীগের মতো হবে—এটা সারাক্ষণ মনে রাখতে হবে।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com