দুর্নীতি
দুর্নীতি

বিশ্লেষণ

পরস্পর যোগসাজশে যেভাবে দুর্নীতি হয়ে থাকে

বাংলাদেশে দুর্নীতির ঘটনাগুলো অনেক সময় এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে মনে হতে পারে এগুলো স্রেফ এক ব্যক্তির অপকর্মের কারণে ঘটেছে। কোনো দুর্নীতির ঘটনায় যখন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তখন শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করাই যথেষ্ট নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দুর্নীতি করতে যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, তাঁদেরও খুঁজে বের করা কেন জরুরি, তা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা

(গত ১৯ জুলাই ছাপা পত্রিকায় অভিমত–বিশ্লেষণ পাতায় এ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সেসময় ছাত্রজনতার আন্দোলন দমনে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক লেখা অনলাইনে প্রকাশ করা যায়নি। ধাপে ধাপে সেগুলো অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। আমরা দুঃখিত যে, এ লেখা অনলাইনে প্রকাশ করতে দেরি হওয়ায়।)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিনঝিন পি তাঁর বই চায়না’স ক্রোনি ক্যাপিটালিজম: দ্য ডায়নামিকস অব রেজিম ডিকে বইয়ে ‘করাপশন বাই কলিউশন’ বা পারস্পরিক যোগসাজশে করা দুর্নীতিকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের একটি নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, পারস্পরিক যোগসাজশে বা যৌথভাবে করা দুর্নীতি একক ব্যক্তির দুর্নীতির চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। এর কারণ হলো এ ধরনের সংঘবদ্ধ দুর্নীতি রাষ্ট্রের সাংগঠনিক এবং আদর্শিক কাঠামোকে ধ্বংস করে।

এ ধরনের দুর্নীতি শনাক্ত করা অধিকতর কঠিন এবং দুর্নীতিবাজদের জন্য অনেক বেশি সুবিধা নিয়ে আসে। দুর্নীতিবাজদের যৌথতার কারণে তাঁদের ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং তাঁদের আধিপত্যের কারণে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর জনগণকে সেবা দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। অনেক সময় পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে যে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও মাস্তানদের সমন্বয়ে এক ‘মাফিয়া’ রাজত্বের কায়েম হয়।

স্বজনতোষী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকারি কর্মকর্তারা যৌথভাবে দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। কারণ, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা একযোগে কাজ করলে কোনো ঘুষ প্রদানকারী ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের অনুমোদন পাইয়ে দিতে সহজ হয়। সবাই দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ঝুঁকি কমে যায়, দুর্নীতির স্বাভাবিকীকরণ করতে সুবিধা হয়।

সবাই মিলে দুর্নীতি করলে এককভাবে কারও ধরা পড়ার ভয় থাকে না, ধরা পড়লেও একদল আরেক দলকে সমর্থন জোগাতে পারে। সরকারি দপ্তরে নিয়োগ দুর্নীতি অনেক সময় যৌথ দুর্নীতির জন্য সুবিধাজনক হয়। দুর্নীতির মধ্য দিয়ে অর্থের বিনিময়ে যখন কেউ নিয়োগ পান, তখন তাঁকে সহজেই যৌথ দুর্নীতির কাজে লাগানো যায়।

নিয়োগের জন্য ব্যয় করা অর্থ তুলে নেওয়ার তাগিদও এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মিনঝিন পির গবেষণাটি চীনের পটভূমিতে করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া শাসনের অধীনে থাকা বাংলাদেশের দুর্নীতির মহামারি বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর ‘পারস্পরিক যোগসাজশে দুর্নীতি’র ধারণাটি কাজে লাগতে পারে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির ঘটনাগুলো অনেক সময় এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে মনে হতে পারে এগুলো স্রেফ এক ব্যক্তির অপকর্মের কারণে ঘটেছে। কিন্তু দেশে যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটছে, সেটাকে ব্যক্তিগত দুর্নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

সম্প্রতি সরকারি দলের সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক বলেছেন, স্বীকার করতেই হবে যে দেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। (স্বীকার করতেই হবে দেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০২৪) প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়া দুর্নীতিকে যদি এখন ব্যক্তিগত দুর্নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে দুর্নীতি নির্মূল করা কখনোই সম্ভব হবে না।

উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণবিষয়ক দুর্নীতির কথা বলা যায়। ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে ভুয়া মালিকানা দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ আত্মসাৎ, ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দেওয়ার নামে কমিশন নেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের দুর্নীতি কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ও দালালদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয়।

যেমন ২০১৮ সালে কক্সবাজার পৌরসভার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কক্সবাজার শহরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কক্সবাজার কার্যালয় নির্মাণ এবং মহেশখালীতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে যে দুর্নীতি হয়, তাতে ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততা ছিল।

প্রকল্প তিনটির জমির ক্ষতিপূরণের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি দালাল চক্র গঠিত হয়, যারা ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ২০-৩০ শতাংশ অর্থ কমিশন হিসেবে নিত। এটা দালাল চক্রের হাত দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। 

এ বিষয়ে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ পদস্থ কর্মকর্তাসহ মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সাতজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পাঁচজন স্থানীয় সাংবাদিক, আটজন আইনজীবী এবং দুজন ব্যাংকারের সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়।

কক্সবাজার থেকে দোহাজারী রেললাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ী ১ হাজার ২১২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মগনামা পেকুয়া নৌবাহিনী ঘাঁটি প্রকল্প এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণেও একইভাবে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি করা হয়। (ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির তদন্তে নেমে বিপদে তিনি, প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

গত ৩০ জুন অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে এক সহকারী পুলিশ সুপারকে (এএসপি) বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর সার্কেলে কর্মরত অবস্থায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অসদুদ্দেশ্যে একটি টিম গঠন করেন। সেই টিমে সদস্য হিসেবে একজন এসআই, তিনজন কনস্টেবল ও একজন গাড়িচালক ছিলেন। (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপন, ৩০ জুন ২০২৪) সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। (প্রশ্নপত্র ফাঁস: পিএসসির ২ উপপরিচালকসহ ১৭ জন গ্রেপ্তার, প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০২৪)

ওপরের ঘটনাগুলোয় পারস্পরিক যোগসাজশে দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এলেও অনেক ক্ষেত্রেই স্রেফ দুর্নীতির অভিযোগে একজন বা দুজন ব্যক্তির নাম আসে, পারস্পরিক যোগসাজশে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে না। যেমন পুলিশ ও র‌্যাবের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে।

এই দুর্নীতির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর মূল দায় থাকলেও দুর্নীতিগুলো করতে গিয়ে তিনি আরও যাঁদের সহযোগিতা পেয়েছেন এবং বিনিময়ে নানা ধরনের সুবিধা দিয়েছেন, অভিযোগে তাঁদের নাম তেমন একটা আসছে না। একইভাবে ছাগল-কাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হলেও যাঁদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে মতিউর দিনের পর দিন তাঁর অবৈধ কর্মকাণ্ড করে গেছেন, তাঁদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে অভিযোগ প্রায়ই আলোচিত হয়, এই চাঁদাবাজি কি এককভাবে কোনো পুলিশ সদস্যের পক্ষে করা সম্ভব? মহাসড়কের অনেক জায়গায় টোকেন বা কার্ড দিয়ে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাসিক ভিত্তিতে ট্রাকপ্রতি চাঁদা আদায় করা হয়। মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাক থামানো হলে টোকেন দেখিয়ে বা টাকা পাঠানোর ফোন নম্বর দিয়ে কল করলে ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হয়। (পণ্যবাহী ট্রাকে উত্তরের পথে পথে চাঁদাবাজি, সমকাল, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

মাসিক চাঁদা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রত্যেকে আলাদাভাবে গ্রহণ করেন, তাহলে একজনের দেওয়া টোকেন অন্যজন গ্রহণ করবেন না, ফলে পুরো প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ কারণেই চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় বা যোগসাজশ করা আবশ্যক হয়ে ওঠে।

এ ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে একজন বা দুজন চাঁদা গ্রহণকারীর বিচার করাই যথেষ্ট হবে না, পুরো দলটিকে শনাক্ত করে বিচার করতে হবে।

ওয়াসার পানির বিল দুর্নীতিতেও বিভিন্ন ব্যক্তির পারস্পরিক যোগসাজশের প্রয়োজন হয়। এই দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক ভবনকে আবাসিক ভবন হিসেবে দেখানো, ভবন নির্মাণের সময় পানির বিল না করা, মিটার খুলে রেখে পানির বিল কমিয়ে দেওয়া, গভীর নলকূপের সংখ্যা গোপন ইত্যাদি। ওয়াসার মিটার রিডারদের একার পক্ষে এই দুর্নীতি করে যাওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য ভবন মালিক, মিটার রিডারদের তদারককারী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও), রাজস্ব কর্মকর্তা এবং ওয়াসার আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। (মিটার রিডারদের হাতে বিলের ‘চোরা চাবি’, সমকাল, ১৯ মার্চ ২০২৪)

একইভাবে রাজনীতিক, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে ‘সিন্ডিকেট’ তৈরির মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ঠিকাদারি কাজের অর্ধেক মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে একদিকে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অন্যদিকে সওজের প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগসাজশ থাকার কারণে তাঁরা বেশির ভাগ কাজ বাগিয়ে নিতে পারেন। অথচ এ ধরনের দুর্নীতি ঠেকাতেই অনলাইনে দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থা (ই-জিপি) চালু করা হয়েছিল।

কিন্তু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের কাছে ঠিকাদারি কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় প্রকাশ করে দেওয়ায় সব ঠিকাদার কাছাকাছি দর প্রস্তাব করে। তখন ঠিকাদার নিয়োগের জন্য ‘পাস্ট পারফরম্যান্স ইভল্যুশন ম্যাট্রিক্স’ বা অতীত পারদর্শিতা মূল্যায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এ পদ্ধতিতে অতীতে যিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন, তিনিই আবার কাজ পেয়ে যান।

এ ছাড়া সহজে দুর্নীতি করার জন্য সওজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা বড় কাজকে অনেক সময় ছোট ছোট অংশে ভাগ করেন। কারণ, ছোট কাজের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে বিল দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট জোনের (অঞ্চলের কার্যালয়) মধ্যে। (সড়কের ৫১% কাজ পেয়েছেন ‘প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ’ ৫ ঠিকাদার, প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর ২০২৩)

এভাবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কাজ পাওয়া পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটিই আবার বিভিন্ন ধরনের নথি জালিয়াতি করে কাজ পেয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর এই জালিয়াতি তারা করতে পেরেছে সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে। কিন্তু জালিয়াতি করে ধরা পড়ে যাওয়া ঠিকাদারদের নিষিদ্ধ করা শুরু হলেও ‘জালিয়াতির সহযোগী’ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। (‘জালিয়াতি’ করে তারা সড়কের বড় ঠিকাদার, প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০২৪)

এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোও কোনো একক ব্যক্তির দুর্নীতির ফল নয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে যে ধরনের যাচাই-বাছাই ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কোনো একজন ব্যক্তির দুর্নীতির মাধ্যমে তা থেকে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভুয়া কাগজপত্র ও জামানত দেখিয়ে বেনামি ঋণ নিতে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও পরিচালক থেকে শুরু করে, এমনকি অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।

যেমন দেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের জন্য প্রধানত পি কে হালদার দায়ী হলেও এই কাজ তার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এই কাজে তাঁকে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের যেমন সহযোগিতা ছিল, তেমনি খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, একাধিক মহাব্যবস্থাপক ও নির্বাহী পরিচালকও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। (পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কর্মকর্তাদের নাম বলেছেন শাহ আলম ও সুর চৌধুরী, প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০২২)

এটা স্পষ্ট যে কোনো দুর্নীতির ঘটনায় যখন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তখন শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করাই যথেষ্ট নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দুর্নীতি সম্পন্ন করতে যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, তাঁদেরও খুঁজে বের করা জরুরি। শুধু একজন অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতির চক্র বন্ধ করা যাবে না, একজনের জায়গা খুব সহজেই অন্য কেউ সেই জায়গা দখল করবেন এবং দুর্নীতির চক্র চালু রাখবেন। এ কারণেই দুর্নীতি দমনের জন্য দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই বিচার করা দরকার।

  • কল্লোল মোস্তফা  লেখক-গবেষক