বাংলাদেশের তোলপাড় করা ক্ষমতার পালাবদল দেখতে এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু ঢাকায় এসেছিলেন। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তোমাদের এখানে গণতন্ত্রের জন্য বারবার আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র অধরাই থেকে গেছে। তাঁর এই যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ কম। যে দেশে গণতন্ত্র থাকে, সে দেশে গণ–অভ্যুত্থান হয় না। ব্রিটেনে গণ–অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা বদলের কথা ভাবা যায় না। সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার বদল হয়। নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতেও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হয়। কিন্তু গত ৭০ বছরেও আমরা সেই ধারা তৈরি করতে পারিনি।
৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের মর্মান্তিক বিদায় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের ঘটনা নিশ্চয়ই দলের নেতা–কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের ব্যথিত ও বিমূঢ় করেছে। তাঁরা এত দিন রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ–সুবিধা ব্যবহার করে ক্ষমতার যে ‘স্বপ্নসৌধ’ নির্মাণ করেছিলেন, এক আন্দোলনের ঝড়ে তা খান খান হয়ে পড়ল।
২০০৮ সালের নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ সব শ্রেণির মানুষের (তরুণদের সমর্থনই ছিল বেশি) ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, সেই দল এভাবে কেন গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল? কারণ নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার সিংহভাগই তারা পূরণ করেনি। আবার যেটুকু পূরণ করেছে, তার সুবিধা পেল ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী।
সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করার আরেকটি কারণ হলো কেউ সরকারের কোনো অন্যায় সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলে, দ্বিমত করলে তাঁদের গায়ে বিএনপি–জামায়াতের তকমা বসিয়ে দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যে মহাবিদ্রোহে রূপ নিল, তার পেছনেও ছিল তাদের ‘রাজাকার’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকতে সাচ্চা গণতান্ত্রিক হয়ে যায়। গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় জোর দিয়ে কথা বলে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে এসব বেমালুম ভুলে যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা আবারও প্রমাণ করলেন।
পৃথিবীর কোনো দেশেই অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত নয়। এটা হলো গণতন্ত্রের জন্য অনুপযোগী নেতা–নেত্রীদের গণতন্ত্র শেখানোর একটি পদ্ধতি, বিকল্প বন্দোবস্ত। এর জন্য এরশাদ আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একসঙ্গে লড়াই করেছে।
আবার বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, বামপন্থীদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করেছিল। এর ফলে দেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এটি ভালো কি মন্দ সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছিল। অনেকে স্বীকার করবেন, সেসব নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছিল।
কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল করে দেয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। গণতন্ত্রের কফিনে সেটাই ছিল সম্ভবত শেষ পেরেক। ক্ষমতা বদলের সর্বজনস্বীকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ করলে কী পরিণতি হয়, আওয়ামী লীগ তা এবার টের পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দৃশ্যমান অনেক উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতু, মোট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হয়েছে। জনগণ এসবের সুফলও পাচ্ছে। অন্যদিকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণতা দেখানোর কথা বলে সেটার প্রসার ঘটিয়েছে। সংবাদমাধ্যম বশীকরণ প্রকল্প দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। সব সরকারের আমলেই প্রশাসনকে প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন ও দলের ভেদরেখাটি পুরোপুরি মুছে ফেলেছে।
২০১১ সালে আদালতের যে রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল, সেই রায়েই দুটি নির্বাচন এর অধীনে করার কথা বলেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর যে তিনটি নির্বাচন হলো, তাতে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ ভোট দিতে পারেননি। ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট, ২০১৮ সালে ‘দিনের ভোট রাতে’, আর ২০২৪ সালে সরকার নির্বাচনের নামে আমি–ডামির অভিনব পদ্ধতি চালু করল। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কেবল দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করেনি, দলের ভেতরেও প্রাণঘাতী সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।
জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে যে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার পেছনেও ছিল নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার বঞ্চনা। তাঁরা রাস্তায় নেমে এসেছেন সরকারের জবরদস্তি ও দুর্নীতির প্রতিবাদ জানাতে। তাঁরা রাস্তায় নেমে এসেছেন ১৫ বছর ধরে সরকারি দলের নেতা–পাতি নেতাদের ঔদ্ধত্যতার জবাব দিতে এবং পাড়ায় পাড়ায় দখলবাজি ও চাঁদাবাজির প্রতিবাদ জানাতে।
সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করার আরেকটি কারণ হলো কেউ সরকারের কোনো অন্যায় সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলে, দ্বিমত করলে তাঁদের গায়ে বিএনপি–জামায়াতের তকমা বসিয়ে দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যে মহাবিদ্রোহে রূপ নিল, তার পেছনেও ছিল তাদের ‘রাজাকার’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।
এই আন্দোলনে বিএনপি–জামায়াতের নেতা–কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকতে পারে, কিন্তু এর নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরাই। সরকার তরুণদের শক্তি বুঝতে ভুল করেছে। আলোচনা করে পরিস্থিতি সামাল না দিয়ে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে বিপুল মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। তারা ভেবেছিল, বিএনপির আন্দোলনকে যেভাবে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করেছে, শিক্ষার্থীদেরও সেভাবে খামোশ করতে পারবে।
ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করতেন তাঁরাই বাংলাদেশ। যাঁরা তাঁদের বিরোধিতা করবে, তাঁরা দেশের শত্রু, জাতির দুশমন বলে চিহ্নিত করা হতো। এই ধারণা একমাত্র স্বৈরতান্ত্রিক দেশেই থাকতে পারে। অথচ আওয়ামী লীগ যে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের আমলে সেটি আরও প্রসারিত হয়েছে। বেনজীর–মতিউরসহ দুর্নীতির বরপুত্রদের একের পর এক কেলেঙ্কারি বের হতে থাকলেও সরকার আমলে নেয়নি। এত বড় দুর্নীতি করেও কীভাবে বেনজীর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, কীভাবে মতিউর আত্মগোপনে থাকেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।
আওয়ামী লীগ সরকার যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে সব অন্যায় ও অপকর্ম আড়াল করতে চেয়েছে, তরুণ প্রজন্ম কোনো ভাবেই তা মেনে নেয়নি। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো ক্যাম্পাসে মুক্ত পরিবেশে থাকা। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনটির দৌরাত্ম্য ও তাণ্ডব বন্ধ করা।
ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনাদের ভুল কি? তারা একবাক্যে বলেছেন, কোনো ভুল নেই। একটি সরকারের সাড়ে পনের বছরে অসংখ্য ভুলকে সঠিক মনে করাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। অদূর ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন এবং এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিলে দেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে। অন্যথায় শাসক বদলাবে, শাসন বদলাবে না।
আওয়ামী লীগ মনে করত, তারাই বাংলাদেশ। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগের বাইরেও বাংলাদেশ আছে। আবার ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে যাঁরা আওয়ামী লীগমুক্ত বাংলাদেশ করার কথা ভাবছেন, তাঁদেরও দেয়ালের লিখন পড়তে বলব।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি