রাষ্ট্র থাকে অনেক দূরে, কে দাঁড়াবে ম্রোদের পাশে

পাহাড়ে ম্রোদের নতুন বছর শুরু হলো হামলা, লুণ্ঠন আর নিষ্ঠুরতা দেখে। এই ম্রোদের ওপর বিরামহীন আক্রমণ চলছে।
ছবি: সংগৃহীত

‘ম্রো’ শব্দের অর্থ হয় ‘মানুষ’, আমি জেনেছি অনেক পরে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও এই মানুষদের কাছ থেকে রাষ্ট্র থাকে অনেক দূরে। তাঁদের ওপর বারবার আক্রমণ হয়, কোনো বিচার হয় না।

কোনো প্রতিকার নেই। ম্রোরা বলছেন, তাঁরা হয়তো এই ভূমিতে আর থাকতে পারবেন না। নতুন বছরের শুরুতে তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে তছনছ করে দেওয়া হলো। এখনো কোনো মামলা হলো না। কেউ গ্রেপ্তার হলো না। প্রথম আলো ২ জানুয়ারি প্রতিবেদন করেছে, লামায় ম্রোদের পাড়ায় আবার হামলা, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। বাড়িঘরে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুরের ছবি ছাপিয়েছে পত্রিকায়। একটি ছবিতে দেখলাম, অসহায় ম্রো মা কোলে একটি শিশু বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সামনে আরও দুটি শিশু আর স্বামী। পেছনে নিশ্চিহ্ন ঘর আর সামনে ছড়িয়ে আছে থালাবাসন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকায় এই ছবি ও প্রতিবেদন দেখলাম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এই ছবি ও খবর। পাহাড়ে ম্রোদের নতুন বছর শুরু হলো হামলা, লুণ্ঠন আর নিষ্ঠুরতা দেখে। এই ম্রোদের ওপর বিরামহীন আক্রমণ চলছে। ২০২২ সালে বহুবার তাঁদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। তাঁরা যে উৎস থেকে পানি পান, সেই পানিতে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে।

কলা চাষ করেছিলেন ম্রো কৃষক, কলার বাগান কেটে ফেলা হয়েছে। জুমের ফসল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এসব খবর ছাপা হয়েছে। ঢাকা শহরের নাগরিক সমাজ বিবৃতিও দিয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও তদন্ত করেছে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে।

পত্রিকায় দেখলাম, বান্দরবান জেলা পরিষদ রাবারবাগানের ইজারা বাতিলের সুপারিশ করেছে (প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০২২)। জেলা পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের মধ্যে রাবারবাগান সৃজন করার শর্তে ১৯৯৬ সালে এই জমি ইজারা দেওয়া হয়। ২৫ বছরেও এখানে রাবারবাগান হয়নি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রথাগত মালিকানা বিবেচনায় এসব ইজারা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে।

২.

ম্রোদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে ফিরে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতে গিয়ে, নব্বই দশকের শুরুতে। আমরা গারোরা নিজেদের মান্দি বলি। মান্দি অর্থও মানুষ। এভাবে সাঁওতালেরা নিজেদের হড় বলে। হড় শব্দের অর্থও মানুষ। অনেক পরে জেনেছি, বম জাতি নিজেদের লাই বা লাইমি বলে। লাইমি মানেও মানুষ। আমাদের দেশে এই ‘মানুষদের’ মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। নতুন বছরের শুরুতে লামায় ম্রোদের ওপর আক্রমণ নতুন করে এই বারতা দিয়ে চলেছে।

২০২২ সালের লোকগণনায় ম্রো জনসংখ্যা ৫২ হাজার ৪৫৫। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষেরদেশে ম্রো জাতি আজ অসহায়।

ম্রোদের গোটা বসতি এভাবে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি; পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল কিংবা মেট্রোরেলের কথা বলি না কেন, ২ হাজার ৮৪৭ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয়ের গল্প বলি না কেন, আমাদের এই রাষ্ট্র, এই সমাজ কতখানি সভ্য ও মানবিক, কতখানি উন্নত, দিন শেষে এসবের বিচার্য বিষয় হবে দেশে সংখ্যালঘু জাতির মানুষেরা কেমন আছেন, তার ওপর। যদি প্রান্তিক মানুষ, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ নিরাপদে না থাকতে পারেন, তবে বুঝতে হবে, আমাদের দেশটি আসলে ঠিকমতো চলছে না। এই উন্নয়নের সব গল্পই অসার বলে বিবেচিত হবে। আমি যখন এই ম্রো, হাজং বা সাঁওতাল জাতির কথা ভাবি, আর ২ হাজার ৮৪৭ ডলার মাথাপিছু আয়ের হিসাব দেখি সরকারি কাগজে, তখন মনে হয়, রাষ্ট্র যেন তার নাগরিকদের সঙ্গে নিষ্ঠুর তামাশা করছে।

আমরা আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বোঝাতে পারি না যে দেশটা সবার। অন্তত কথা ছিল, দেশটা হবে সবার। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা বলেছিলাম, এখানে সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করব। সেই ঘোষণার কত দূরে চলে গেছে দেশটা। তবু আমাদের মানতে হবে, এখানে বাঙালি ছাড়াও নানা জাতির মানুষ আছে।

পৃথিবীর সভ্য রাষ্ট্রের বড় কাজ হলো সমাজের সবচেয়ে অসহায়, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু মানুষের পাশে থাকা, প্রভাবশালী ও শক্তিমানদের আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করা।

দয়া করে একবার কুলাউড়ার একজন খাসিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কেমন আছেন? তাঁর ভূমিতে আক্রমণ হয়েছিল, কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। একটু সৎ হোন আর জিজ্ঞাসা করুন, গাইবান্ধার সাঁওতাল দ্বিজেন টুডুকে, মহাদেবপুরে আলফ্রেড সরেনের কন্যাকে, মধুপুরে পীরেন স্নালের স্ত্রীকে, চলেশ রিছিলের মেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে, বাঘাইছড়ির কল্পনা চাকমার ভাইকে, গোমস্তাপুরের বিচিত্রা তির্কিকে কিংবা সুন্দরবনের পাশে শ্যামনগরে নরেন্দ্র মুন্ডার পরিবারকে। তারা কেমন আছেন? এমন আরও অসংখ্য ঘটনার কথা বলতে পারি। যদি জবাব পান, তাঁরা ভালো আছেন, তবে খুশি হব। কিন্তু সত্য হলো, এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনোটারই সুষ্ঠু প্রতিকার মেলেনি। তবু আমরা তরতর করে এগিয়ে চলেছি বটে!

৩.

আমরা আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বোঝাতে পারি না যে দেশটা সবার। অন্তত কথা ছিল, দেশটা হবে সবার। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা বলেছিলাম, এখানে সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করব। সেই ঘোষণার কত দূরে চলে গেছে দেশটা। তবু আমাদের মানতে হবে, এখানে বাঙালি ছাড়াও নানা জাতির মানুষ আছে। এখন আমি একটি তথ্য দিতে চাই। সেটা সরকারি তথ্য। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের ২৩ মার্চের গেজেট অনুযায়ী, ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষায় প্রকাশ করেছে, দেশে মাতৃভাষা আছে ৪১টি। এখানে বাংলা ও উর্দু ভাষা বাদ দিলে বাকি ৩৯টি ভাষাই হলো আমাদের ভাষা।

এই সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজে বলেছে, এখানে ১৪টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। আরও অনেক ভাষা বিপন্ন। এই হলো আমাদের দেশে সংখ্যালঘু জাতির মানুষের অবস্থা।

২০১৮ সালের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বলেছিল, নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করলে একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে তারা। গত চার বছরে কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। আমি চাই দ্রুত ভূমি কমিশন কাজ করুক। আলোচনায় বসে ঠিক করুক ভূমি সমস্যা সমাধানের। ম্রোদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াক। বিরাজমান পরিস্থিতিতে খুব আশাবাদী হতে পারি না।

বছরের শুরুতে আশা বেঁধে রাখতে হয়। আমরাও আশা রাখি, একদিন রাষ্ট্র অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও মানবিক হবে। দেশে একটি সংবেদনশীল আদিবাসী নীতি থাকবে। সে নীতির মূল কথা হবে, ইনডিজিনাস টাচ। অসীম নম্রতা, শুদ্ধতা ও উদারতা নিয়ে লেখা হবে সেই নীতিমালার বাক্যগুলো।

আমাদের সবাইকে মিলেমিশে রাষ্ট্রকে তার সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। দেশে মানুষে মানুষে যোগাযোগের সংবাহন বিন্দু গড়ে উঠবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই অথবা আকাশসীমার এক পৃথিবী রক্ত সবার লাল—কথাগুলো সত্যি হবে। এখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমার সঙ্গে সাঙ্গু-মাইনী-বুগাই-সোমেশ্বরী নদীকে মেলানোর আয়োজন শুরু হবে, জীবনে জীবন যোগ হবে—এই হোক আমাদের চিরকালের আকাঙ্ক্ষা।

  • সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
    ই-মেইল: sanjeebdrong@gmail.com