২৯ এপ্রিল ২০২৩। চট করে দিনটির বিশেষত্ব যে কারও পক্ষে ধরা কঠিন। আমাদের জাতীয় গৌরবময় দিনগুলোর কথা কমবেশি সবারই জানা; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দিবসগুলোও পালিত হয় ঘটা করে। সুতরাং শুরুতে উল্লিখিত দিনটি নিয়ে ধন্দে পড়াই স্বাভাবিক। দিবসটি ছিল রাজধানীর কলাবাগান এলাকার তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার প্রথম বর্ষপূর্তি।
গুরুত্ব বিচারে সংবাদটি আহামরি কিছু নয়, কিন্তু ঢাকার বাসিন্দামাত্রই জানেন, এ মহানগরের ‘নাই’ তালিকার প্রথম দিকেই রয়েছে মাঠ। তাই গত বছর যখন রীতিমতো নাগরিক আন্দোলন-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এই একচিলতে মাঠটিকে রক্ষা করতে হয়, তার বর্ষপূর্তি তাই একের ভেতরে পাঁচের অধিক কিছু সামনে আনে। স্বভাবতই খবরটির গুরুত্বে তখন যুক্ত হয় ভিন্নমাত্রা।
‘ঈদ’ ছোটগল্পের রজব ও তার মা ফাতিমার বঞ্চিত-অপমানিত জীবনে উৎসবের প্রয়োজনীয়তা কীভাবে যে ফুরায়, তা-ই প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই করুণ কাহিনির অন্যদিকে ঈদের ছুটি যে হাজারো রজবের জন্য নির্মল আনন্দের ‘দুয়ার’ খুলে দেয়, তার প্রমাণ আরেক দফায় পাওয়া গেল এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির সময়।
ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগেরই যেহেতু নাড়ি পোতা গাঁওগেরামের মাটিতে, তাই ঈদ-পার্বণে তাঁরা ঢাকা ছাড়েন। এই ফাঁকা ঢাকার বহু গলি-তস্য গলি হয়ে ওঠে রজবদের ‘খেলার মাঠ’। শুধু বস্তিবাসী রজবদের নয়, মধ্যবিত্তের বিরাট অংশের ছেলেপুলেরা ফুটবল বা ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়ে সরু সরু গলিতে। ছুটির এই বাড়তি আবহের সঙ্গে তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার বর্ষপূর্তি তাই একাকার হয়ে যায়।
দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেরও বিদ্যালয়গামী কোনো ছেলের হাফপ্যান্টের পকেটে লাটিম বা মার্বেল পাওয়ার কথা ভাবা যায় এখন? কিংবা টিফিনের সময় কাজে লাগাবে বলে কোনো মেয়ে ব্যাগে করে লুকিয়ে নিয়ে যায় দড়িলাফের সামগ্রী? এসবের সঙ্গে ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’ কিংবা এক্কা-দোক্কা, ডাংগুলি, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, হাডুডু, কিতকিত ইত্যাদি খেলাও শিশু-কিশোরদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
যুগটা এখন ইঁদুরদৌড়ের। ক্ষেত্রবিশেষে নিজের প্রায় সমান ওজনের ব্যাগ পিঠে চেপে বিদ্যালয়ে ছুটতে হয় শিশুদের। পড়াশোনায় ‘ভালো’ করার প্রতিযোগিতায় নেমে তাদের অধিকাংশকেই থাকতে হয় খেলার মাঠ থেকে শত হস্ত দূরে। অথচ বিজ্ঞানের ভাষ্য পরিষ্কার: শৈশবের দিনগুলোতে মনোযোগ বাড়াতে খেলাধুলা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শারীরিক ও মানসিক—উভয় বৃদ্ধিতে খেলাধুলা যে বিকল্পহীন, তা বহু গবেষণায় প্রমাণিত। ‘জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, শুধু মনোযোগ বৃদ্ধিই নয়, শিশুর সামগ্রিক সুস্থতায় নিয়মিত খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু তারপরও কি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেরও বিদ্যালয়গামী কোনো ছেলের হাফপ্যান্টের পকেটে লাটিম বা মার্বেল পাওয়ার কথা ভাবা যায় এখন? কিংবা টিফিনের সময় কাজে লাগাবে বলে কোনো মেয়ে ব্যাগে করে লুকিয়ে নিয়ে যায় দড়িলাফের সামগ্রী? এসবের সঙ্গে ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’ কিংবা এক্কা-দোক্কা, ডাংগুলি, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, হাডুডু, কিতকিত ইত্যাদি খেলাও শিশু-কিশোরদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
বুড়ি ছোঁয়া, চোর-পুলিশের মতো খেলাগুলোও। একইভাবে মাটিতে ছক কেটে ষোলো ঘুঁটি অথবা বাঘবন্দী, লুডু বা ক্যারম খেলার দৃশ্যও তেমন দেখা যায় না। হ্যাঁ, এসব খেলার অনেকগুলো শুধুই বিনোদন। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে ছোটরা একসঙ্গে কোনো কিছু করার শিক্ষা পায়। নিজেদের মধ্যে গড়ে ওঠে সহজ আন্তরিক সম্পর্ক। দলবদ্ধতার এই প্রবণতা পরে সামাজিক নানা উদ্যোগে যৌথভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। বাংলার ঐতিহ্যের, এই ভূখণ্ডের আলাদা পরিচয়ের স্মারকও এসব লোকজ খেলা।
কিন্তু শিশুরা এখন এসব খেলার জায়গায় ব্যস্ত মুঠোফোন-ট্যাবে। শহরের শিশুরা তো বটেই, গ্রামগঞ্জেরও অনেক ছেলেমেয়ে ইন্টারনেট ও মোবাইল গেমে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এর মধ্য দিয়ে শৈশবেই তারা কম্পিউটার ব্যবহারে অনেকটা সড়গড় হচ্ছে বটে, যা তাদের ভবিষ্যতে কাজকর্মে সুবিধা করে দিতে পারে। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার জো নেই যে মোবাইল বা ইন্টারনেট মাধ্যমেই ব্লু হোয়েল, মোমোর মতো ভয়ংকর খেলার বিস্তার ঘটছে। পাশাপাশি একসঙ্গে খেলার মধ্য দিয়ে দলবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হওয়ার বিপরীতে শিশুদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একা থাকার, একাই ভোগ করার মানসিকতা।
কোনো সামাজিক কল্যাণকর কাজে একসঙ্গে এগিয়ে আসার চেতনা তাই কমছে। আর বাড়িতে মোবাইলে মেতে থাকা শিশুদের সেভাবে শরীরচর্চাও হয় না। ফলে স্থূলতার সমস্যা বাড়ছে। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে মানসিক বিকাশও।
এরপরও ‘গরিব’ রজব বা ‘মধ্যবিত্ত’ রজবদের যারাই যতটুকুই খেলতে চায়, ঢাকা শহরে তার ব্যবস্থা কতটুকু আছে, তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার বর্ষপূর্তির মধ্যে সেই ‘বার্তা’ নিহিত। খোলাসা করে বললে বলতে হয়, একটি শহরে প্রত্যেক মানুষের জন্য থাকা দরকার ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা, ঢাকায় আছে ১ বর্গমিটার (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। জনসংখ্যার হিসাবে এ মহানগরে থাকার কথা প্রায় ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠ, সেখানে দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে সংখ্যাটি ২৩৫, অর্থাৎ ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ১০০ মাঠের। এখানেই শেষ নয়, ঢাকার মাঠগুলোর অধিকাংশই (১৪১) কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের, যেখানে সাধারণ মানুষের তথা রজবদের প্রবেশাধিকার নেই।
এমনও দেখেছি, বিদ্যালয়ের আগে বা পরে প্রাইভেট পড়তে এসেছে এক দল কিশোর। কিছুটা সময় আছে হাতে। সরু গলির মাঝে স্কুলব্যাগ দাঁড় করিয়ে ‘স্টাম্প’ বানিয়ে শুরু করে দিয়ে ক্রিকেট খেলা। এমন দৃশ্য দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মাস্টারবাবু’ কবিতার শেষ চারটি চরণই বারবার মনে পড়ে, ‘আমি ওরে বলি বার বার,/ “পড়ার সময় তুমি পোড়ো-/ তার পরে ছুটি হয়ে গেলে/ খেলার সময় খেলা কোরো।’ কিন্তু ওরা খেলবে কোথায়?
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহ–সম্পাদক
hello.hasanimam@gmail.com