সংবাদ সম্মেলনে গাজার পরিস্থিতি জানাচ্ছেন মেয়র ইয়াহইয়া আর সাররাজ
সংবাদ সম্মেলনে গাজার পরিস্থিতি জানাচ্ছেন মেয়র ইয়াহইয়া আর সাররাজ

গাজার মেয়রের খোলাচিঠি

আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি সব কিছুই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে

আশির দশকে আমি ছিলাম কৈশোরে। আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব রাশাদ আল-শাবার নামে তখন গাজা শহরে গড়ে উঠছে রাশাদ আল শাবা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। অপূর্ব তার স্থাপত্যরীতি। একে একে ওখানে নাট্যমঞ্চ হলো, বড় হলঘর হলো। আমরা গণগ্রন্থাগার, ছাপাখানা পেলাম। সংস্কৃতিকর্মী-বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হলো আল শাবা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

গাজা উপত্যকার সব জায়গা থেকে ছাত্রছাত্রী, গবেষক, শিল্পীরা এখানে আসতেন। ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও এখানে এসেছিলেন। এই কেন্দ্র ছিল গাজা শহরের রত্ন। সত্যি বলতে, এই ভবনের নির্মাণশৈলী আমাকে প্রকৌশলী হতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সেখান থেকে আমি অধ্যাপক হয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত এই আল শাবা আমাকে গাজা শহরের মেয়র করেছিল।

আমার শহরের রত্নটি ইসরায়েলি বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন পড়ে আছে ইট, পাথর আর সুরকি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এ অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি স্থাপনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ইসরায়েলিরা আরও যা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে, তা হলো গাজা শহরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক সব স্থাপনা ও পৌর প্রতিষ্ঠানগুলো।

গাজায় অন্তহীন বোমা হামলায় সব গেছে। গাজার পরিচয়বাহী সব প্রতীক, সমুদ্রতীর ও সমুদ্রতীরবর্তী অপরূপ শহর, গ্রন্থাগার, অভিলেখ্যাগার, যা কিছু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারত, তার সব। আমার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

গাজার চিড়িয়াখানাটাও নেই। আমাদের চিড়িয়াখানায় নেকড়ে, হায়েনা, নানা জাতের পাখি আর বিরল প্রজাতির শিয়াল ছিল। ওরা হয় ওদের হত্যা করেছে, নয়তো জন্তুগুলো না খেতে পেয়ে মারা গেছে। শহরের প্রধান গ্রন্থাগার, শিশুদের হ্যাপিনেস সেন্টার, পৌর ভবন ও অভিলেখ্যাগার, সপ্তম শতকের গ্রেট ওমরি মস্ক—সব গেছে। ইসরায়েলি বাহিনী রাস্তাঘাট, মসজিদ, গির্জা, উদ্যান কোনো কিছুই ছাড়েনি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সব।

হামাস প্রশাসন ২০১৯ সালে যখন আমাকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দিল, আমার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল সমুদ্রসৈকতটার উন্নয়ন করা। আমি চেয়েছিলাম শহরের এই অংশের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে কিছু মানুষের কাজের সংস্থান হবে। চার বছর লেগেছিল প্রকল্পটা শেষ করতে। সাগরের ধার ঘেঁষে মানুষের হাঁটার জন্য একটা পথ তৈরি করিয়েছিলাম, বিনোদনের কিছু ব্যবস্থা আর ছোটখাটো ব্যবসাকেন্দ্র হয়েছিল।

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আচরণ কেন ইসরায়েলি বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মতো হতে পারে না? কেন আমরা একটু শান্তিতে বাঁচতে পারব না? কেন আমরা মুক্ত বাণিজ্যের জন্য আমাদের সীমান্ত খুলে দিতে পারব না? ফিলিস্তিনিরা মুক্ত জাতি হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য দাবিদার। গাজা ফিনিক্স পাখির প্রতীক। ভস্ম থেকে আবারও তার পুনরুত্থান হবে। গাজায় আবারও শোনা যাবে প্রাণের স্পন্দন।

নিভিনের (গাজার একজন নারী) বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। কথা ছিল, এই নভেম্বরে ওখানে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ করবে। নিভিনের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। মোহাম্মদ, ওই যে প্রতিবন্ধী ছেলেটা, ওর একটা ছোট্ট ক্যাফে ছিল। নেই আর। শেষ। পুরো এলাকাটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে ইসরায়েলের সময় লেগেছে কয়েক সপ্তাহ।

ইসরায়েলি ট্যাংক এত গাছ ধ্বংস করল কেন? এত বৈদ্যুতিক খুঁটি, ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা পানির সংযোগ? ওরা কেন জাতিসংঘের স্কুলে হামলা চালাল? গাজা থেকে ওরা আমাদের জীবনযাপনের চিহ্ন যেভাবে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা অবর্ণনীয়। আমার এখনো মনে হয়, আমি এক দুঃস্বপ্নের ভেতর আছি। আমি ভাবতেও পারি না, কীভাবে বিবেকবান মানুষ ধ্বংস ও মৃত্যুর এমন ভয়ানক অভিযানে যুক্ত হতে পারে।

গাজার আধুনিক পৌরসভা স্থাপিত হয়েছিল ১৮৯৩ সালে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন পৌর এলাকা এটি। এই এলাকাভুক্ত মানুষের সংখ্যা আট লাখ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনি থাকে এই অঞ্চলে। যুদ্ধের শুরুতে উত্তর গাজা থেকে ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পৌর এলাকার বেশির ভাগ মানুষ আগের জায়গায়ই থেকে গেছেন।

হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল যখন যুদ্ধ শুরু করে, তখন আমি দেশের বাইরে। আমি আমার সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত এলাকায় ফিরি। উদ্দেশ্য, এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছানো। আমি একটা জরুরি সহায়তা কমিটির প্রধান। এই দলে পৌরসভার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা আছেন। তাঁরা পানির পাইপ মেরামত, রাস্তা চলার উপযোগী রাখা, রোগ ছড়াতে পারে এমন পয়োবর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা সরানোর কাজ করছেন। আমাদের ১৪ জন সদস্য মারা গেছেন। আমরা সবাই হয় আমাদের বাড়ি হারিয়েছি, নয়তো স্বজন।

আমি নিজেও হারিয়েছি আমার স্বজন। কোনো সতর্কসংকেত ছাড়াই আমার বাড়িতে হামলা হয় গত ২২ অক্টোবর। আমার বড় ছেলে রুশদি ছিল ফটোসাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। বোমা হামলায় সে নিহত হয়। রুশদি ভেবেছিল, মা–বাবার বাড়িতে সে নিরাপদ থাকবে। মাঝেমধ্যে আমি ভাবি, আমিই কি ইসরায়েলিদের নিশানা ছিলাম? এ তথ্য অজানাই থেকে যাবে। আমি রুশদিকে মাটি দিয়ে জরুরি সহায়তা কমিটিতে কাজে ফিরলাম।

ইসরায়েল ১৬ বছর আগে আমাদের এই অঞ্চলে অবরোধ শুরু করেছে। আর জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার বিবেচনায় তাদের দখলদারির সূচনা আরও আগে।

এই অবরোধ, এই দখলদারি আমাদের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসরায়েলের এক অজ্ঞাতনামা সেনা কর্মকর্তা গাজাকে তাঁবুর শহরে পরিণত করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিলেন। আর ইসরায়েলও গাজার বাসিন্দাদের জোর করে বাস্তুচ্যুত করতে শুরু করল। তাহলে অন্তত একবার ফিলিস্তিনিদের যে প্রতিশ্রুতি দিল, তা অটুট রাখল ইসরায়েল! আমি বিশ্বের সব পৌরসভা, সব মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা বিশ্বনেতাদের ওপর জোর করুন। এই খ্যাপা ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করুন।

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আচরণ কেন ইসরায়েলি বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মতো হতে পারে না? কেন আমরা একটু শান্তিতে বাঁচতে পারব না? কেন আমরা মুক্ত বাণিজ্যের জন্য আমাদের সীমান্ত খুলে দিতে পারব না? ফিলিস্তিনিরা মুক্ত জাতি হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য দাবিদার। গাজা ফিনিক্স পাখির প্রতীক। ভস্ম থেকে আবারও তার পুনরুত্থান হবে। গাজায় আবারও শোনা যাবে প্রাণের স্পন্দন।

  • ইয়াহইয়া আর সাররাজ গাজা শহরের মেয়র এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসের সাবেক রেক্টর

    দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনূদিত