মতামত

রাশিয়াকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা যে কারণে কাজে আসছে না

ইইউকে নতুন নিষেধাজ্ঞা নীতি গ্রহণ করতে হবে
ইইউকে নতুন নিষেধাজ্ঞা নীতি গ্রহণ করতে হবে

২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর এক দিন পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আগ্রাসকের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মস্কোর উদ্দেশ্যে সুস্পষ্ট এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে তাদের এই আগ্রাসনের পরিণতি হবে ভয়াবহ।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ঘিরে থাকা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি ও দেশটির অর্থনীতির বেশ কিছু খাতকে লক্ষ্যবস্তু করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপরের মাসগুলোয় আট দফায় নিষেধাজ্ঞার আওতা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাশিয়া থেকে ইউরোপে তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, এমন যেকোনো পণ্য রাশিয়াতে রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা।

রুশ আগ্রাসনের মাত্রা কমার কোনো লক্ষণ দেখতে না পাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত রাখছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের অঙ্গীকার ছাড়া এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যর্থ হতে বাধ্য। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর যতটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি টেকসই রয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি। বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার সক্ষমতা এখনো অটুট রয়েছে রাশিয়ার।

এ ছাড়া যেসব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও কোনো না কোনোভাবে রাশিয়ায় যাচ্ছে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা যেভাবে ফলপ্রসূ হওয়া দরকার ছিল, সেটা না হওয়ার কারণ হলো আমরা নিজেরাই সেটা যথাযথভাবে মানছি না। সম্প্রতি নরওয়েভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা কোরিস্কের প্রতিবেদন থেকে বেরিয়ে এসেছে, কীভাবে এটা ঘটছে।

 যুদ্ধের এই সন্ধিক্ষণে নিষেধাজ্ঞা শুধু প্রয়োগ করলেই চলবে না, সেটা যাতে প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন করা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধে এরই মধ্যে অনেক ইউক্রেনীয় নিহত হয়েছেন। দেশকে বাঁচাতে ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা লড়ে যাচ্ছেন। আমরা তঁাদের ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১২টি দেশ, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২২ সালে এসব দেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হওয়া নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পণ্যের পরিমাণ সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার। এটা বিস্ময়কর বটে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পণ্য রপ্তানিতে জার্মানি প্রথম এবং লিথুয়ানিয়া দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে জার্মানির ব্যবসায়ীরা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে রাশিয়ার কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করছে। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এসব পণ্য রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোয় রপ্তানি হয়েছে। এরপর সেসব দেশ থেকে সেগুলো রাশিয়ায় গেছে। এই বিকল্প রপ্তানির প্রায় অর্ধেকটা হয়েছে কাজাখস্তানের মাধ্যমে। বাকি অর্ধেকটা জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, কিরগিজস্তান ও অন্য দেশগুলোর মাধ্যমে হয়েছে।

বেসামরিক ও সামরিক—দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়, এমন পণ্যও এভাবে রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ড্রোন, যানবাহন ও রাসায়নিক দ্রব্যও রয়েছে। মাঝারি ধরনের ট্রাক যুদ্ধক্ষেত্রে মালামাল ও রসদ সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই এ ধরনের ট্রাক রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ফলে ২০২২ সালের মে মাসের মধ্যে জার্মানি থেকে রাশিয়ায় এ ধরনের ট্রাকের রপ্তানি শূন্যে নেমে আসে।

যাহোক, জার্মানি থেকে আর্মেনিয়ায় এখন মাঝারি আকারের ট্রাকের রপ্তানি বিপুল পরিমাণ বেড়েছে। জার্মানি রাশিয়ায় যে পরিমাণ ট্রাক রপ্তানি করত, আর্মেনিয়ায় এখন তার পাঁচ গুণ বেশি রপ্তানি করে। লিথুয়ানিয়া থেকে বেলারুশ হয়ে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। গত বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে লিথুয়ানিয়া থেকে বেলারুশে যানবাহন রপ্তানি আগের তুলনায় ১০ গুণ বেড়েছে।

সামরিক ও বেসামরিক দুই কাজেই ব্যবহৃত হয়, এমন পণ্য এবং যুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নতুন নিষেধাজ্ঞা বিধি তৈরি করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা প্রদানকারী জোটের দেশগুলো মিলে একটি যৌথ অনুসন্ধান টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে।

 যুদ্ধের এই সন্ধিক্ষণে নিষেধাজ্ঞা শুধু প্রয়োগ করলেই চলবে না, সেটা যাতে প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন করা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধে এরই মধ্যে অনেক ইউক্রেনীয় নিহত হয়েছেন। দেশকে বাঁচাতে ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা লড়ে যাচ্ছেন। আমরা তঁাদের ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।

  • বেরিত লিন্ডেম্যান নরওয়েজিয়ান হেলসিঙ্কি কমিটির মহাসচিব

  • আইভার ডেল নরওয়েজিয়ান হেলসিঙ্কি কমিটির জ্যেষ্ঠ নীতি উপদেষ্টা