বাংলাদেশের রাজনীতি দখলে এগিয়ে আছেন মূলত ব্যবসায়ীরা। আশপাশের দেশগুলোতেও সে রকমই প্রবণতা। একসময় ধারণা দেওয়া হতো, বাণিজ্যের সফল উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রের কাজে নতুন গতি, উদ্যম ও সুশাসন আনতে পারেন। সেই আশায় তাঁদের ‘জায়গা’ করে দেওয়া হয় উদ্দীপনার সঙ্গে। প্রত্যাশা মেটেনি। কেবল তাঁদের অর্থবিত্তের সঙ্গে ‘ক্ষমতা’র যোগ বেড়েছে।
এরপর বিশ্বজুড়ে আরেক প্রবণতা এসেছে। রাজনীতিতে আসতে লাগলেন নানান কলাবিদ্যার সেলিব্রিটি বা তারকারা। জনগণও বেশ আগ্রহভরে সাড়া দিচ্ছে তাতে। আগামী নির্বাচনেও গান থেকে খেলাধুলা পর্যন্ত ‘তারকাজগতে’র অনেকে ভোটে দাঁড়াতে শামিল হতে পারেন রাজনীতিতে।
কিন্তু কেন অ–রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি বানাতে চাইবে মানুষ? এটা কি রাজনীতির প্রতি গভীর কোনো অনাস্থার কারণে? এর ফলই–বা কী দাঁড়াচ্ছে? প্রশ্নটা অন্যভাবেও করা যায়, শাসক অভিজাতদের নতুন জ্বালানি হওয়াই কি কলাকারদের শেষ গন্তব্য? এটা শিল্প-সাহিত্য-খেলাধুলার জগতের দলীয়করণকে উসকে দিচ্ছে কি না?
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অরাজনৈতিক সেলিব্রিটি হিসেবে সম্প্রতি বেশ নজর কেড়েছেন নেপালের বালেন শাহ। কাঠমান্ডুর মেয়র তিনি এখন। নেপালে ডান-বাম শক্তপোক্ত রাজনীতিবিদের কমতি নেই। তাঁদের বাদ দিয়ে তরুণ এই ‘র্যাপার’কে কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রশাসকের দায়িত্ব দিল জনগণ, এই ধাঁধার কোনো উত্তর মেলাতে পারছেন না স্থানীয় সাংবাদিকেরা। আরেক সেলিব্রিটি রবি লামিচানকে নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন উত্তেজনা। আগামী নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে জনপ্রিয় এই উপস্থাপক নতুন দলই গঠন করে ফেলেছেন। বালেন শাহর সফলতা তাঁকে ভোটের রাজনীতিতে আগ্রহী করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রবি লামিচানের অনুসারীর সংখ্যা নেপালের রাজনীতির তিন মুরব্বি কে পি ওলি, শের বাহাদুর দেউবা ও পুষ্পকুমার দাহালের যৌথ সংখ্যার চেয়েও বেশি। ভোটে এর একটা পার্শ্বফল থাকবেই। নেপালিদের এত দিনকার কোনো লড়াই-সংগ্রামে ছিলেন না লামিচানে। তবু জনতা তাঁর প্রতি উৎসাহী। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে সমাজ রূপান্তরের সংগ্রামে যে রাজনীতিবিদেরা সর্বোচ্চ দিলেন, জনতা এখন তাঁদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
নেপালের মতোই অবস্থা হবে ভারতের আগামী নির্বাচনেও। সেখানে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পৃথ্বীরাজ কাপুরকে দিয়ে সেলিব্রিটিদের রাজনীতিতে টানার সূচনা ঘটিয়েছিলেন খোদ নেহরু। গুরুর দেখানো ওই পথ এখন কংগ্রেসের জন্য বুমেরাং হয়েছে। বিজেপি ওই ঐতিহ্যকে শিল্পের স্তরে নিয়ে গেছে। হেমা মালিনী থেকে অনুপম খের পর্যন্ত তাদের সেলিব্রিটি রাজনীতিকের তালিকা অনেক লম্বা।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে ঠেকাতে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমের তারকাদের তৃণমূলে ভিড়িয়েছেন। পুরো টালিগঞ্জকে তিনি নির্বাচনী প্রচারে টেনে আনেন বা তারাও আসে! মমতার এ কৌশল ভালো কাজে দিয়েছে বলে অনুমান করা হয়। শুরুতে তাঁর বড় অস্ত্র ছিলেন কবীর সুমন।
এখন আছেন নুসরাত জাহান, মিমি চক্রবর্তীরা। তাঁদের মোকাবিলায় বিজেপি নিয়ে আসে রূপা গাঙ্গুলি, লকেট চ্যাটার্জিদের। দক্ষিণ ভারতে তারকারা অনেক দিন ধরে রাজনীতির চালকের আসনে আছেন কমবেশি। কিন্তু কোথাও দেশটির সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার দলন রুখতে রাজনীতির সেলিব্রিটিরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছেন—এমন নজির মিলছে না। বরং ‘বলিউড’ সশরীর পাশে দাঁড়িয়ে প্রায়ই টিম-মোদির সব সাম্প্রদায়িক প্রান্তিকরণকে হাসিমুখে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের বেলায় দেখা যাচ্ছে, ক্যাপ্টেন খানের (ইমরান খান) পাশেই সেলিব্রিটির সংখ্যা বেশি। খোদ খানই ক্রিকেট তারকার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে নেমে রাজনৈতিক খেলার ছক খানেক পাল্টে দিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রের সংস্কার করতে পেরেছেন, এমন বলা যায় না। যদিও সেটা তাঁর অঙ্গীকার ছিল। একই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি বা চেষ্টা করেননি সরফরাজ নেওয়াজও।
তারপরও ইমরানের পাশে জড়ো আছেন এখনো অভিনয়জগতের আদনান সিদ্দিকী, মাহিরা খান, হুমায়ুন সাঈদ, গায়ক বিলাল মাকসুদ প্রমুখ। কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক অসাম্যে তাঁদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। বালুচ-হাজারা-আহমদিয়ারা যে জুলুমের শিকার হচ্ছে, তাতে এই সেলিব্রিটিরা রাষ্ট্রকে কিছু বলেন না। সমাজে বহুত্ববাদের পরিসর বাড়াতে তাঁরা কেউ শাসক ইমরানকে চাপ দেননি।
বাংলাদেশেও রাজনীতি তুমুলভাবে আকর্ষণ করছে সেলিব্রিটিদের এবং জনগণ যে তাঁদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে অপেক্ষায় আছে, তারও লক্ষণ আছে। বিএনপিতে ইতিমধ্যে সংগীতশিল্পী কনক চাঁপা, বেবী নাজনীন, চিত্রনায়ক হেলাল খান, ফুটবলার আমিনুল ইসলামের নাম সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে শোনা গেছে। আসিফ আকবর ও মনির খান এ তালিকায় যুক্ত হবেন কি না, সে বিষয়ে স্থানীয় জল্পনাকল্পনার শেষ নেই।
আওয়ামী লীগে এ রকম তারকাদের অবস্থান আরও অনেক ব্যাপক। ইতিমধ্যে সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান খান দুর্জয়, মাশরাফি বিন মুর্তজা, ফুটবলার সালাম মুর্শেদী। আছেন গায়িকা মমতাজ। রাজনীতিবিদ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের কবরী সারোয়ারের অভিজ্ঞতাও আমরা যুক্ত করতে পারি এই তালিকায়। তাঁদের ‘ক্ষমতা’র হাত ধরে ফুটবল, ক্রিকেট, চলচ্চিত্র বিশেষভাবে কী পেয়েছে, সে প্রশ্ন নিয়ে অবশ্য কোনো আলোচনা দেখা যায় না।
নানান ধরনের কলাবিদ তারকাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে আগমনের পথ করে দেওয়ায় বড় ভূমিকায় আছে অবশ্যই মিডিয়া। মূলধারার মিডিয়া এবং ফেসবুক-টুইটার মিলে কলাবিদদের ‘জনপ্রিয়তা’র ভিত্তি গড়তে প্রাথমিকভাবে সাহায্য করে। একই কায়দায় একই মিডিয়া আগের দফায় বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের সুশাসক প্রোফাইল বানিয়েছে, কিন্তু তার কোনো সুফল পাননি ভোটাররা।
তবে নিশ্চয়ই কেবল ‘মিডিয়া’ এ রকম সবার লোকপ্রিয়তার একমাত্র কারণ নয়। প্রথাগত রাজনীতির প্রতি জনতার মোহভঙ্গও এ প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। মানুষ রাজনীতিবিদদের সরাসরি পায় না। তাঁদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে। রাজনীতিবিদদের জীবনধারায় তারা অনেক অস্বচ্ছতা দেখে। সেই তুলনায় তারকাদের জীবনযাপনকে তাদের কাছে অনেক প্রত্যক্ষ মনে হয়।
তাঁদের ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রামে যুক্ত হয়ে দর্শক-শ্রোতা মনে করতে থাকে এই তারকাজীবনের সে–ও অংশীদার। ভোট দিয়ে এই তারকাদের আরও কাছাকাছি আনা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোও এ রকম তারকাদের দলীয় ব্যানারে নামাতে চায় নিজেদের কর্মসূচি ও আবেদনের দুর্বলতা আড়াল করতে। রাষ্ট্রীয় ‘ব্যবস্থা’রও এতে উৎসাহ আছে। তাতে অর্থনৈতিক বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় অনাচারসহ বহু কিছু আড়াল করা যায়।
তবে মুশকিল বাধান বালেন শাহ, তৈমুর রহমান বা কবীর সুমনের মতো রাজনীতিবিদেরা। কিংবা দামিথা আবেরতে,œ শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাত্রদের পাশে থেকে এই সেলিব্রিটি আটক হলেন সম্প্রতি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য।
বাংলাদেশে একদম পাওয়া যাচ্ছে না এ রকম রাজনৈতিক সেলিব্রিটিদের যাঁরা সুশাসনের বধ্যভূমিতে মুক্তির কোনো নতুন গান শোনাতে পারেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর কোনো সমাধান কলাকারদের হাতে নেই।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক