মতামত

সেলফি কূটনীতি, বাণিজ্য ও নির্বাচনী রাজনীতি

ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ঢাকায় সাধারণ মানুষের মন জয়ের জন্য যতটা জনসংযোগ করলেন, তা সত্যিই চমকপ্রদ
ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ঢাকায় সাধারণ মানুষের মন জয়ের জন্য যতটা জনসংযোগ করলেন, তা সত্যিই চমকপ্রদ

কূটনৈতিক পরিসরে গত সপ্তাহ ছিল বাংলাদেশের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে ঘটনাবহুল, নজরকাড়া ও আলোচিত। বহু দশক পরে ঢাকার মাটিতে পা ফেলেন ইউক্রেন আগ্রাসনের জন্য প্রায় একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।

তারপর শিল্পোন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জোট জি–২০-এর শীর্ষ সম্মেলনে আয়োজক ভারতের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যান, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলা এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের বিশেষ সৌজন্য প্রকাশের ঘটনা।

ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নিয়ে যতটা কৌতূহল ও জল্পনা ছিল, তা ততটা আলোচিত হলো না। এরপর ঢাকায় ঝটিকা সফরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বাংলাদেশিদের মন জয় করতে যা করে গেলেন, তার রেশ এখনো তরতাজা। কয়েকটা দিন যে সরকারের জন্য বেশ ফুরফুরে ছিল, সন্দেহ নেই। তবে তার স্থায়িত্ব নিশ্চিত নয়।

যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে নজর দেওয়ার জন্য এবং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, যাকে সরকারের অনেকেই তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন, তখন এসব কূটনৈতিক যোগাযোগ ও আচার-আচরণের বিশেষ তাৎপর্য অনস্বীকার্য।

অবশ্য সময় টিভিতে প্রচারিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মুখে জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সেলফি ও আলোচনার যে বিবরণ পাওয়া গেল, তা বরং ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি নিয়ে অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সম্মেলনের বিরতির সময় সাধারণ সৌজন্য বিনিময় ও সম্মেলনের বিবেচ্য বিষয়ের বাইরে দেশের জন্য সরকার কত ভালো কাজ করছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বোঝানোর চেষ্টা করার বিবরণ একজন নাগরিক হিসেবে শুনতে ভালো লাগে না। এতে কি মনে হয় না যে আমাদের ভালো-মন্দের বিষয়ে আমরা বাইরের কারও সম্মতি অথবা অনুমোদন চাইছি? 

প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ঢাকায় সাধারণ মানুষের মন জয়ের জন্য যতটা জনসংযোগ করলেন, তা সত্যিই চমকপ্রদ। স্বদেশে পেনশনব্যবস্থার সংস্কারে অবসর নেওয়ার বয়সসীমা বাড়ানোর কারণে যখন তাঁর জনসমর্থন মাত্র ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে, তখন এ রকম জনসংযোগ প্যারিসে হলে হয়তো তিনি অনেক বেশি উপকৃত হতেন। অবশ্য বিক্ষোভের মুখে পড়ার ঝুঁকি সেখানে অনেক বেশি ছিল। মাত্র কয়েক দিন আগেই এ রকম অপ্রীতিকর অবস্থার মুখে তিনি পড়েছিলেন।

নির্বাচনের মাত্র মাস চারেক বাকি থাকতে এত বিশাল অঙ্কের আর্থিক দায়সম্পন্ন ক্রয় চুক্তি একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য মোটেও স্বাভাবিক নয়। নির্বাচনে সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে চুক্তি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি বা নতুন করে দেনদরবার করার প্রশ্ন যেখানে অবশ্যম্ভাবী, সেখানে এ রকম চুক্তির ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। এমনিতে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা যা, তাতে ঐতিহাসিকভাবে লোকসানে জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠানের বিমান কেনার যৌক্তিকতা এখনো দেশের মধ্যেই মীমাংসিত নয়।

ফরাসি কূটনীতিকদের কারও কারও এবং সেখানকার সাংবাদিকদেরও অনেকের আশঙ্কা ছিল, ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানার কঠিন আইন তৈরির কারণে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করতে পারে। কয়েক বছর আগে শার্লি এবদো পত্রিকায় কার্টুন প্রকাশের জেরে ফরাসি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ঢাকায় যে বিক্ষোভ হয়েছিল এবং দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের হুমকি সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত আছে, সেটাই তাঁদের আশঙ্কার কারণ। নির্ভেজাল সফরের পর তাঁদের সেই ধারণা কতটা বদলাবে, তা অবশ্য অনুমান করা কঠিন। 

প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সফরে ফ্রান্সের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যই যে মুখ্য ছিল, তা দুই দেশের যৌথ ঘোষণা ও তাঁর বক্তব্যে খুবই স্পষ্ট। যৌথ ঘোষণার শুরুতে অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রসার, শান্তি বজায় রাখা ও টেকসই উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে বন্ধুত্বের গভীরতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পুরো ঘোষণায় গণতন্ত্রের বিচ্যুতি ও ঘাটতির বিষয়গুলো নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ বা মানবাধিকারের সুরক্ষায় আশু করণীয় নিয়ে কোনো যৌথ অঙ্গীকার নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার বিষয়ে সহযোগিতার বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা আছে, কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ছাড়া সেসব উদ্যোগ যে ফলপ্রসূ হয় না, তার কোনো স্বীকৃতি এতে নেই। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় (ম্যানগ্রোভ) বনাঞ্চল সুন্দরবন বিপন্ন করার জন্য যখন বিশ্বের পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে, তখন ফ্রান্স সেখানে দেখেছে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ হচ্ছে এবং তা-ই তার প্রশংসা করেছে। 

এই সফরে বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, যদিও আগামী মাসে তুলুজে দুই দেশের একটি বিনিয়োগ সম্মেলনের উল্লেখ আছে এ বিবৃতিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়া স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানিবিষয়ক একটি প্রকল্পের অর্থায়নে ২০ কোটি ডলার অর্থায়নের একটি চুক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাপ্তি। বিপরীতে একটি সমঝোতা হয়েছে ১০টি এয়ারবাস কেনার, যার জন্য ব্যয় হবে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। এই বিমান কেনার চুক্তিতে অবশ্য যুক্তরাজ্যেরও কিছু ভূমিকা আছে, কেননা তারা এর অর্থায়নে ঋণ জোগান দেওয়ার একটি সমঝোতা এর আগেই করেছে। আর এয়ারবাসের রোলস-রয়েস ইঞ্জিন যুক্তরাজ্যেই তৈরি হয়। ফ্রান্স এককভাবে যে ব্যবসা পাচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় আরেকটি উপগ্রহ নির্মাণ ও সরবরাহের।

ফ্রান্সের এই বড় অঙ্কের ব্যবসা বাগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিতে অনেক বিশ্লেষকই অবাক হয়েছেন। নির্বাচনের মাত্র মাস চারেক বাকি থাকতে এত বিশাল অঙ্কের আর্থিক দায়সম্পন্ন ক্রয় চুক্তি একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য মোটেও স্বাভাবিক নয়। নির্বাচনে সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে চুক্তি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি বা নতুন করে দেনদরবার করার প্রশ্ন যেখানে অবশ্যম্ভাবী, সেখানে এ রকম চুক্তির ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। এমনিতে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা যা, তাতে ঐতিহাসিকভাবে লোকসানে জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠানের বিমান কেনার যৌক্তিকতা এখনো দেশের মধ্যেই মীমাংসিত নয়।

দ্য ডেইলি স্টার–এ ১২ সেপ্টেম্বরের একটি প্রতিবেদন বলছে, বিমান নিজেই এখনো তাদের বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করার আর্থিক ও কৌশলগত সমীক্ষা সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি। পাশাপাশি ভিয়েতনাম একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০টি বোয়িং বিমান কিনছে, যার প্রতিটির দাম পড়বে ১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, আর আমরা এয়ারবাস কিনছি প্রতিটি ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার করে। এই চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক।

একই কথা ওঠে স্যাটেলাইট প্রশ্নে। কেননা, প্রথম স্যাটেলাইটের খরচ মাত্রাতিরিক্ত ছিল এবং তার আয়ও খুব সামান্য। তাই নতুন স্যাটেলাইটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির আলোচনাও রয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে সামরিক সহযোগিতার যে উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রির উদ্যোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি। 

মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সফরের আগেই তাঁর প্রতি খোলাচিঠি দিয়ে মানবাধিকারের বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল এবং তা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল। একান্তে সে ধরনের কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু প্রকাশিত বিবৃতিতে সে রকম কিছু নেই।

এমানুয়েল মাখোঁ মানবাধিকারের চেয়ে ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বলে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন দেশটির জিআইজিএ ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক জেসমিন লর্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর ‘তৃতীয় পথ’–এর প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের জন্য একটি উপহার বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। সফরের দুই দেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করলে এ বক্তব্য নাকচ করা যাবে না।

এমানুয়েল মাখোঁ তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে পলাশী যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাংলাকে ফ্রান্সের সমর্থন দেওয়ার কথা বলেছেন। সেই সমর্থনেরও উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য করা। তখন সেই সমর্থনে বাংলার যেমন কোনো লাভ হয়নি, ফ্রান্সেরও আর বাণিজ্য হয়নি। প্রেসিডেন্ট মাখোঁর আগে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁ। কিন্তু সেই সফরে দুই দেশের সম্পর্কে যে তেমন একটা হেরফের ঘটেছে, তা বলা যাবে না। আর তখন বৈধতার সংকটে থাকা এরশাদেরও কোনো রাজনৈতিক ফায়দা হয়নি। 

কামাল আহমেদ সাংবাদিক