বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের অনেকের গভীর প্রেম ফেব্রুয়ারি মাসে নানাভাবে উসকে ওঠে। অন্তর্জালিক দুনিয়ায় সবকিছুকে ভাইরাল করাটাই যেখানে চরম মোক্ষ, সেখানে একদল মৌসুমি ভাষাপ্রেমীর আবির্ভাব হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এসব ভাষাপ্রেমী বইমেলা কিংবা অন্য কোনো জনসমাগমে আগতদের (মূলত কিশোর বয়সীদের) ভাষাবিষয়ক পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।
সেই পরীক্ষায় যেমন প্রশ্ন থাকে ভাষা দিবস কবে, ভাষাশহীদদের নাম কী, আবার ইংরেজি না বলে এক মিনিট বাংলায় কথা বলার মতো অবাস্তব প্রশ্নও থাকে। পরীক্ষায় বেশির ভাগই ডাহা ফেল করে। ফেলের বাংলা যদিও ‘অকৃতকার্য’, কিন্তু দেশের শিক্ষিত-আধা শিক্ষিত-অশিক্ষিতনির্বিশেষে ‘ফেল’ শব্দটি ব্যবহার করে।
ফেসবুক, ইউটিউবে ভাইরাল হওয়া এসব ভিডিও দেখে, অন্যদের না জানার, কম জানার বহর দেখে, তাঁদের অপদস্থ হতে দেখে, নিঃসন্দেহে আমরা সম্মিলিতভাবে মজা পাই। আর যাঁরা একটু ভাবনা-চিন্তা করেন, তাঁরা হয়তো হতাশ হন এই ভেবে যে আমাদের শিক্ষার মানটা কোন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে!
কিন্তু যে গুরুতর প্রশ্ন এখানে সবাই এড়িয়ে যান, তা হলো, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যবহার কতটা কার্যকর হলো।
সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে অতি ভাষাপ্রেমীদের উদ্দেশে জরুরি প্রশ্নটি হলো, জনপরিসরে এভাবে হুটহাট ভাষার পরীক্ষা নেওয়ার অধিকার তাঁদের কে দিল? ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে কাউকে কাউকে গণ-অবমাননার মুখোমুখি করার অধিকার তাঁরা কোথা থেকে পেলেন?
কাউকে যখন ইংরেজি না বলে এক মিনিট বাংলা বলার জন্য বলা হয়, তখন প্রশ্নকর্তাই ভুলে যান, মিনিট শব্দটা বাংলা কি না। তিনি ভুলে যান যে ভাষা প্রবহমান প্রাণসত্তা। যে ভাষার গ্রহণসক্ষমতা যত বেশি, সে ভাষা তত বেশি জীবন্ত। আজকের যে বাংলা ভাষা, সেখানে যেটাকে দেশি শব্দ বলি, তার সংখ্যা এখন বাস্তবে হাতে গোনা।
কেননা, যে সমাজে সম্পর্ক বা উৎপাদনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে এসব শব্দ প্রচলিত ছিল, সেই ব্যবস্থার অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে। নানা সময়ে নানা জাতিগোষ্ঠী এখানে এসেছে, এখানকার জনজাতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাদের বয়ে আনা ভাষা ও সংস্কৃতির নানা শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বাংলা ভাষার সঙ্গে।
খুব একটা ব্যতিক্রম বাদে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য বাংলা মাধ্যম আর নিম্নবিত্তদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার একটা অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। কে কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, শ্রমবাজারে সে কোন ধরনের কাজে নিয়োজিত হবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
ভাষা প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইতিহাসের নানা কাল পর্বজুড়ে আমরা নানা বিদেশিদের দ্বারা শাসিত হয়েছি। সেসব শাসকের ভাষা আমাদের অধিপতি শ্রেণি গ্রহণ করেছে। কখনো সংস্কৃত, কখনো আরবি-ফারসি, আবার কখনো ইংরেজি।
গত দুই দশকে ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে একটা যে বৈশ্বিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা থেকেও আমরা কিংবা বাংলা ভাষা বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে বাংলা ভাষা কতটা প্রভাবশালী হবে, তা নির্ভর করে আমাদের ভাষাটা কতটা শক্তিশালী।
তার মানে বৈশ্বিক জ্ঞানভান্ডারে, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং অতি অবশ্যই প্রযুক্তিতে কতটা প্রভাব রাখতে পারছে বাংলাভাষীরা। এখানেই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটা সামগ্রিকভাবে চলে আসে। যে দেশে একদিন ভাষার দাবিতে আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল, সে দেশে এখনো সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু হলো না কেন?
বামপন্থী লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলা ভাষার আজকের দুর্গতির কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ‘ভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল, শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যম হতে হবে বাংলা ভাষা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো পরিকল্পনা ছাড়া রাতারাতি শিক্ষার মাধ্যম করা হলো। একটা ভাষা থেকে আরেকটা ভাষায় শিক্ষার মাধ্যম বদলাতে গেলে সেটা খুবই পরিকল্পিতভাবে করতে হয়। বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে গেলে বই লাগবে। আগে ইংরেজিতে শুধু বক্তৃতা দেওয়া হতো না, বাংলা ছাড়া সব বিষয়ে বই ইংরেজিতেই ছিল। রাতারাতি শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করায় কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় বক্তৃতা শুরু হলো। ইংরেজি বই গায়েব হয়ে গেল। শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বাংলায় অথচ বাংলায় বই নেই। ফলে রাতারাতি শিক্ষার মান পড়ে গেল। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই আজেবাজে নোট বই বের হতে লাগল। ছাত্রছাত্রীরা মূল বই না পড়ে ছোট ছোট নোট বই পড়ে শিখতে লাগল। এভাবে যারা শিক্ষিত হলো, পরে তারা আবার মাস্টার হলো।’ (বাংলা ভাষাটা শিক্ষিত লোকের চেয়ে গরিবদের অনেক বেশি দরকার, প্রথম আলো ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)
বদরুদ্দীন উমর সমাধান হিসেবে সুস্পষ্টভাবে বলেন, সরকারি উদ্যোগে অনুবাদ সংস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যের বই বাংলাভাষীদের কাছে সহজেই পৌঁছানো যায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরও সে উদ্যোগ কি আছে? এই বাস্তবতা কয়েক মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন চালু রেখেছে, আবার তাতে সামাজিক বৈষম্যটা দিনে দিনে অসহনীয় রূপ নিচ্ছে।
খুব একটা ব্যতিক্রম বাদে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য বাংলা মাধ্যম আর নিম্নবিত্তদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার একটা অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। কে কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, শ্রমবাজারে সে কোন ধরনের কাজে নিয়োজিত হবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু না হলে নিছক ‘ভাষাপ্রেম’ কোনো অর্থই বহন করে না। গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আজম মনে করেন, বাংলা ভাষা চর্চার প্রথম ক্ষেত্রটা হতে হবে শিক্ষায়। তাঁর মতে, শিক্ষাটা হওয়া উচিত প্রথম ভাষা বাংলায়। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা শিখবে। এ দেশের ভদ্রলোক শ্রেণি আর বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করে না। যারা ইংরেজি কিনতে পারে না, তারাই কেবল বাংলায় পড়ে। আর যারা সেটাও পারছে না, তারা মাদ্রাসায় পড়ছে কিংবা পড়ছে না। এটা একটা ভয়াবহ অবস্থা। রাষ্ট্র তো সেই শ্রেণিই চালাচ্ছে, যারা ইংরেজি কিনতে পারছে। (যারা ইংরেজি কিনতে পারে না, তারাই বাংলায় পড়ে, প্রথম আলো ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২)
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী