গাজা যুদ্ধ শেষে যে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম হবে

গাজার বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত।
গাজার বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত।

গাজা যুদ্ধ শেষে মধ্যপ্রাচ্য দেখতে কেমন হবে, তা নিয়ে আগে থেকে পুরোপুরিভাবে অনুমান করা সম্ভব নয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশ্য এ সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম দেখতে পাচ্ছেন। গাজা যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, সেটা আমরা এখনো জানি না। এ যুদ্ধে একপক্ষীয় মহাবিপর্যয়ের তথ্যপ্রমাণ বেড়েই চলেছে। এ পর্যন্ত ১৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। গাজার বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত।

মধ্যপ্রাচ্যের ‘নতুন চেহারা’কে আমরা বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর স্রোত হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এটি ১৯৪৮ সালের মতো করে নাকবা সৃষ্টির চেষ্টা, সেই ঘটনায় বাস্তুচ্যুতদের উত্তরসূরিরা এখন গাজার শরণার্থীশিবিরগুলোতে বাস করে। আমরা এখন আবার আরেকটি গণবাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি। গাজার এ পরিস্থিতি সিরিয়া যুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয়। সিরিয়া যুদ্ধের কারণে, জনাকীর্ণ শরণার্থীশিবির ও অমানবিক পরিবেশে বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষ বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এখন বাস্তুচ্যুত মানুষের নতুন প্রজন্মের জন্ম হচ্ছে। জর্ডানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, জর্ডানিদের তুলনায় সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্মহার বেশি। তুরস্ক, লেবানন, জর্ডান, ইরাক ও মিসরে নিবন্ধন করা সিরীয় শরণার্থীর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। সিরিয়ার ভেতরেও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ। তাঁদের অধিকাংশকে বিরুদ্ধ পরিবেশ ও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে।

ইয়েমেন যুদ্ধও মধ্যপ্রাচ্যে শরণার্থী সংকট উসকে দিয়েছে। এ যুদ্ধে ৪৫ লাখ মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের কারণে গত দুই দশকে শরণার্থীর স্রোত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিতে হয়েছে। এ তালিকায় এখন গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এ যুদ্ধে একেকটা পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য মারা যাওয়ায় মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মও তৈরি করবে।

ঘরবাড়ি-বসতি থেকে উচ্ছেদের এই বাস্তবতা চরমপন্থা, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ও আক্রোশের জন্ম দেবে। এই বাস্তবতা অসন্তুষ্ট তরুণদের ইসলামিক স্টেটের মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোতে যুক্ত হওয়ার প্ররোচনা জোগাবে।

গাজা যুদ্ধ শেষে যে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের’ জন্ম হবে, সেখানে অরাষ্ট্রীয় ও আধা রাষ্ট্রীয় খেলোয়াড়দের ভূমিকা বাড়বে। এ যুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই হামাসের (হামাসকে যুক্তরাজ্যসহ আরও কিছু দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন বলে) মতো সংগঠনের প্রাসঙ্গিকতা অনেক বাড়িয়ে দেবে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের ভূমিকা আরও বাড়বে।

গাজা যুদ্ধ আরও যেসব গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবে, তার মধ্যে সিরিয়ার হায়াত তাহিরির আল-শাম ইন ইদলিব, কুর্দিনিয়ন্ত্রিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের মতো সংগঠন রয়েছে। আমরা এ ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থানের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর শক্তি ক্ষয় হতে দেখব।

অরাষ্ট্রীয় ও আধা রাষ্ট্রীয় এসব সংগঠনের উত্থান হলে আরব জাতিরাষ্ট্র ধারণা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এর ফলাফল হবে মারাত্মক। এতে জাতিগত, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক নানা গোষ্ঠীর পুনর্জন্ম হবে। মধ্যপ্রাচ্যের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর বিভাজন ও ভাঙন ডেকে আনবে।

আন্তসীমান্ত সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়বে। আঞ্চলিক যুদ্ধের ধরনও পরিবর্তন হতে আমরা দেখব। শহর অঞ্চলে যুদ্ধ বাড়বে। এ ছাড়া প্রক্সি যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, প্রোপাগান্ডা ও অপতথ্যের বিস্তার হতে দেখব।

একই সঙ্গে গাজা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশল–নীতিগত গুরুত্বের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে চীন ও রাশিয়া তাদের প্রভাব তৈরি করছিল, যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল। গাজা যুদ্ধ সেই নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনতে পারে।

মোহাম্মদ আবু রুম্মান ইউনিভার্সিটি অব জর্ডানের রাজনীতি বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক

মিডল-ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত