২০১৭ সালে জি–২০ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন
২০১৭ সালে জি–২০ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন

ট্রাম্পের কাছে পুতিন কী চান, কী দিতে পারবেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দেশের ভেতরে ও বিশ্বমঞ্চে কী নীতি গ্রহণ করবেন, তা নিয়ে জল্পনা বাড়ছে, নানাজন নানা পরামর্শও দিচ্ছেন। এর মধ্যে অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন, ইউক্রেনের ব্যাপারে ট্রাম্পের কী করা উচিত, তা নিয়ে।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পরপরই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি—দুজনকে সম্পৃক্ত করে তিনি এটা করবেন। কিন্তু এর বাইরে যে যা কিছু বলুক না কেন, সেটা আন্দাজে বলা ছাড়া কিছু নয়।

এসব আন্দাজও নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী ধারণাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ অস্ত্রবিরতি চুক্তি চাইছেন। অন্যরা একটা নিরাপত্তাবলয়ের কথা বলছেন, যেটা আবার নিশ্চিত করবে ইউরোপিয়ানরা। কেউ কেউ মনে করছেন, রাশিয়াকে একটা ‘পুরস্কার’ দেওয়া দরকার, ইউক্রেনে যে ভূমি রাশিয়া দখলে নিয়েছে, সেটা তাদের দিয়ে দেওয়া হোক। অনেকে আবার বলছেন, চুক্তিতে এমন শর্ত থাকতে হবে, যেন ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়টি অন্তত ২০ বছর বন্ধ থাকে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাশিয়ানরা কী চায়, সেই ধারণা আসলে কারও নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন কাণ্ডজ্ঞানবোধসম্পন্ন মধ্যস্থতাকারী। তিনি চাইবেন, তাঁর প্রতিপক্ষ আসলে কী চায়, সেটা জানতে এবং এমন একটা পথ বের করতে, যেখানে সেই চাওয়াকে স্থান দেওয়া যায় অথবা প্রতিপক্ষ লাভবান হয়।

রাশিয়ার চাওয়াগুলোর মধ্য কিছু চাওয়া খুবই পরিষ্কার। কিন্তু তাদের বাকি দাবিগুলো স্পষ্ট নয়।

রাশিয়া যে ভূখণ্ড নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, সেটার সুরক্ষার ওপর জোর দেবে। অন্য কোনো সমাধান, যেমন অস্ত্রবিরতি, নিরপেক্ষ অঞ্চল তৈরি করার মতো সমাধান রাশিয়ার নেতাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না। রাশিয়া এ পর্যন্ত ইউক্রেনের যতটা ভূখণ্ড অধিকারে নিয়েছে, তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দাবি করবে। এর মানে হচ্ছে, বর্ধিত ভূখণ্ড নিয়ে যেকোনো আলোচনা আসলে মানচিত্রবিষয়ক আলোচনা।

যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো, শুধু ইউক্রেন নয়, ন্যাটো মিত্রদেরও রাশিয়ার এই বর্ধিত অংশের দাবির প্রতি ঐকমত্য থাকতে হবে।

ইউক্রেনে সরকার যেহেতু পরিবর্তন হয়, সে কারণে রাশিয়া চাইবে এমন একটি চুক্তি করতে, যেটা খুব জোরালো হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যটা একতরফা। যুক্তরাষ্ট্র চায় রাশিয়া যেন ইউক্রেন থেকে চলে যায়। এটা ট্রাম্পের অবস্থান নয়। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, এই সংঘাতে তিনি সফল হতে পারবেন না। বিশেষ করে এই বিবেচনা থেকে যে রাশিয়া এই যুদ্ধ জিতে চলেছে।

রাশিয়া চাইবে ইউক্রেনে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষার নিশ্চয়তা। একই সঙ্গে রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চের সুরক্ষা। এ সবকিছুই ইউক্রেনের আক্রমণের শিকার হয়েছে।
রাশিয়া আগে থেকেই জোর দিয়ে বলে আসছে, ইউক্রেনে তাদের যুদ্ধের একটা কারণ হলো, তারা দেশটিতে বসবাসকারী রাশানদের সুরক্ষা দিতে চায়।

রাশিয়ায় অর্থডক্স চার্চের গুরুত্ব এবং পুতিন ও অন্যদের ওপর তার প্রভাবের কথা বিবেচনায় নিলে এটা বলা যায় যে পুতিন এমন কোনো চুক্তি মেনে নেবেন না, যেখানে রুশভাষী লোকেরা ও চার্চগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে অথবা সরকারিভাবে কোনো বৈষম্যের শিকার হয়।

রাশিয়া চাইবে কিয়েভে যেন মস্কোর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন সরকার ক্ষমতায় থাকে। এই সংঘাতের একেবারে শুরুটা যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব, কিয়েভে রাশিয়ার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন সরকারের পরিবর্তে রাশিয়ার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন সরকারকে বসানোর মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত হয়েছিল। একই সঙ্গে সেটা শুরু হয়েছিল, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে মস্কো থেকে বিচ্ছিন্ন করে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নমুখী করার মধ্য দিয়ে।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হোক, সেটা রাশিয়া কোনোভাবেই রাজি হবে না। তারা নিশ্চিতভাবেই দাবি জানাবে, ইউক্রেন ন্যাটোর বলয় থেকে বের হয়ে আসুক। রাশিয়া আরও চাইবে ইউক্রেনকে বড়ভাবে নিরস্ত্রীকরণ করতে।

রাশিয়া চাইবে ন্যাটো যেন ইউক্রেনে আর কোনো অস্ত্র সরবরাহ না করে। ইউক্রেনে ছেড়ে সব পরামর্শক ও ভাড়াটে সেনারা যাতে চলে যায়।

এ ছাড়া রাশিয়া চাইবে তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে। এর পরিবর্তে রাশিয়া ইউক্রেনীয়দের ব্যবসা ও বাণিজ্য বিকাশের সুযোগ করে দেবে।

এ ছাড়া কৃষ্ণসাগরের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা দর–কষাকষির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। সবচেয়ে বড় একটা ইস্যু হবে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত কমিয়ে আনা।

সর্বোপরি, রাশিয়া অবশ্যই অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দাবি জানাবে।

রাশিয়ার এসব ‘দাবির’ বিষয়ে ট্রাম্পকে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু একবারে বাস্তবায়নের জন্য এটা অনেকে দাবি। জেলেনস্কি সরকারের কাছ থেকে বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়বেন ট্রাম্প। যা–ই হোক, যেকোনো চুক্তি সফল হতে গেলে ধাপে ধাপে সেটা বাস্তবায়ন করা জরুরি।

ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, রাশিয়া ইউরোপিয়ানদের বড় যে হুমকি তৈরি করেছে, সেটা কমানো। ইউরোপের নেতাদের ভয়ের কারণ হলো, রাশিয়ার কাছে এখন একটি অভিজ্ঞ ও বিশাল সেনাবাহিনী রয়েছে। ফলে রাশিয়া বাল্টিক দেশগুলো অথবা পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় আক্রমণ করে বসতে পারে।

ইউরোপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা শক্তিশালী করার প্রচেষ্টাটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সেটা যে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জার্মানিতে ক্ষমতাসীনদের জোট ভেঙে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে কিছু দেশের নিজেদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার মতো সম্পদ নেই। তাহলে তারা কীভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থের জোগান দেবে।

এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে এমন একটা স্থিতিবস্থায় যাওয়া, যেখানে কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যটা একতরফা। যুক্তরাষ্ট্র চায় রাশিয়া যেন ইউক্রেন থেকে চলে যায়। এটা ট্রাম্পের অবস্থান নয়। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, এই সংঘাতে তিনি সফল হতে পারবেন না। বিশেষ করে এই বিবেচনা থেকে যে রাশিয়া এই যুদ্ধ জিতে চলেছে।

কিন্তু ট্রাম্প এটা ভালো করেই জানেন যে চুক্তিকে কীভাবে মধুর করে তুলতে হয় এবং কী করলে রাশিয়ানরা তাঁর কথা শুনবেন। সুতরাং, ট্রাম্প এমন একটা বন্দোবস্ত করবেন, যেটা সংঘাতের অবসান ঘটাবে।

  • স্টিফেন ব্রায়েন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত