মতামত

উৎপীড়ক প্রেসিডেন্টদের কবল থেকে শ্রীলঙ্কার মুক্তি কীভাবে

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে
এএফপি

শ্রীলঙ্কার মানুষ অত্যাচারী প্রেসিডেন্ট পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সৃষ্ট প্রেসিডেন্ট পদে জে আর জয়াবর্ধনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই পদে যিনিই বসেছেন, তিনিই কোনো না কোনো আদলে বিপজ্জনক স্বৈরাচারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। এমনকি উদার শাসনব্যবস্থা ও শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়া প্রেসিডেন্টরাও শেষমেশ নৃশংস শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

চলতি বছরের ২১ জুলাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে গদিতে বসা রনিল বিক্রমাসিংহের বিদ্যমান শাসনেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিক্রমাসিংহে (যিনি কিনা ঘটনাক্রমে জে আর জয়াবর্ধনের ভাতিজা) পার্লামেন্টের ভোটের মাধ্যমে পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বিক্রমাসিংহে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি এবং তিনিই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট, যিনি একজন পদত্যাগকারী প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হলেন।

বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট পদে বসার এক দিনেরও কম সময়ের মধ্যে কলম্বোয় এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বিক্ষোভ (যাকে সিংহলি ভাষায় বলা হচ্ছে ‘আরাগালিয়া’ যার অর্থ ‘সিংহলিদের সংগ্রাম’ বলা হয়) শুরু করা আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেন। তখন থেকেই বিক্রমাসিংহে লাগাতারভাবে ধরপাকড় অভিযান চালাচ্ছেন এবং দমনমূলক কায়দায় মিথ্যা অভিযোগে প্রতিবাদকারীদের আটক করছেন। শুরুর দিকে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে বিক্রমাসিংহ একচ্ছত্র ক্ষমতা খাটানোর অবস্থা তৈরি করে লোকজনকে নির্বিচার আটক করতে থাকেন।

এরপর তিনি সন্ত্রাস দমন আইন (প্রিভেনশন অব টেররিজম অ্যাক্ট, সংক্ষেপে পিটিএ) নামের একটি কালাকানুন প্রয়োগ করেছেন, যা বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করা সহজ করেছে। এই আইন দিয়ে কোনো অভিযোগ ছাড়াই কাউকে আটক করা সম্ভব হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি করা ‘সন্ত্রাসবাদ’ ধারণা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশানা করে সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। গৃহযুদ্ধের সময় বহু বছর ধরে (এবং তার পরেও) এই তকমাটি তামিল সম্প্রদায়কে নির্যাতন করার জন্য ব্যবহার করা হতো এবং ২০১৯ সালের ইস্টার বোমা হামলার পরে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিক্রমাসিংহের অধীনে পিটিএর সর্বশেষ নিশানা হলো আরাগালিয়া আন্দোলনকারীরা। তাঁদের মধ্যে ছাত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা আছেন। সরকার তাঁদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে ধরপাকড় চালাচ্ছে। শুধু শ্রীলঙ্কানদের প্রতিবাদ থামাতে তাঁদের ভয় দেখাতে এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। বিক্রমাসিংহে কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার সমাজে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেকে উদারপন্থী এবং গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন, তাঁর সাম্প্রতিক অত্যাচার সেই ভানসর্বস্ব ভণ্ডামিকে প্রকাশ করে দিয়েছে।

বিক্রমাসিংহে এবং তাঁর সমর্থকেরা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এতটা মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ তাঁর শাসন চরম অস্থির অবস্থায় রয়েছে। একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর সরকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। সেই দিক থেকে তাঁর রাজনৈতিক স্বীকৃতির খামতি আছে। এ ছাড়া তঁার সরকার রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা পোডুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) সঙ্গে সুবিধাবাদী জোট হিসেবে কাজ করছে।

বিক্রমাসিংহে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে রাজাপক্ষে ভাইদের কথিত দুর্নীতি ও অপরাধ আড়াল করার জন্য ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিলেন। অথচ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তিনি রাজাপক্ষে পরিবারের দুষ্কর্মের বিচার করবেন বলে ভোটারদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে জয়াবর্ধনের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে কুখ্যাত বাটালান্দা নির্যাতনকেন্দ্রের সঙ্গে যোগসাজশ থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এখন তিনি চলমান দমন-পীড়ন কমিয়ে আনার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার চালাচ্ছেন। সাময়িকভাবে জ্বালানি সরবরাহ কিছুটা বাড়িয়ে এবং লোডশেডিং কিছুটা কমিয়ে তিনি এখন বর্তমান বাস্তবতাকে একটি স্থিতিশীলতার চিত্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন।

যেসব সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা রাজাপক্ষে পরিবারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন, তঁারা এখন হয় বিক্রমাসিংহের ক্ষমতার অপব্যবহারকে ছোট করে দেখছেন, নয়তো একেবারে নীরব হয়ে আছেন।

শ্রীলঙ্কার বিদ্যমান চরম শ্রেণিগত ব্যবধান প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করেছে। জ্বালানিসংকট ও দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার কবলে পড়ে শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্তরা, এমনকি ধনিক শ্রেণি আরগালিয়া বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। বিক্রমাসিংহে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ কিছুটা বাড়িয়ে এই দুই শ্রেণির যন্ত্রণা কিছুটা কমিয়েছেন, যা তাদের বিক্ষোভ থেকে অনেকটাই বিরত রাখতে সহায়তা করেছে।

এটা মোটেও কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে আন্দোলনকর্মী এবং ছাত্রদের মধ্যে যাঁদের পাকড়াও করা হচ্ছে, তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমিকশ্রেণির এবং দরিদ্র শ্রীলঙ্কান। তাঁদের খুব সহজেই হিংস্র এবং উচ্ছৃঙ্খল হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। তাঁদের গায়ে এমনভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে তকমা সেটে দেওয়া হচ্ছে, যার কারণে সমাজের বাকি অংশ তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশে অস্বীকার করছে। 

বিক্রমাসিংহে এবং তাঁর সমর্থকেরা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এতটা মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ তাঁর শাসন চরম অস্থির অবস্থায় রয়েছে। একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর সরকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। সেই দিক থেকে তাঁর রাজনৈতিক স্বীকৃতির খামতি আছে। এ ছাড়া তঁার সরকার রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা পোডুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) সঙ্গে সুবিধাবাদী জোট হিসেবে কাজ করছে।

তাদের এই জোট পারস্পরিক স্বার্থের কারণে আগাম নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে; কারণ তারা ভালো করে জানে নির্বাচন হলে তারা উভয়েই প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়বে। যাহোক, এসএলপিপির ওপর বিক্রমাসিংহের নির্জলা নির্ভরতা এবং এসএলপিপির তলানিতে ঠেকা গ্রহণযোগ্যতার মানে হলো এই জোট দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে না।

এ ছাড়া দেশের সর্পিল অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শ্রীলঙ্কার সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও অরক্ষিত নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার উপায় বাতলানোর বিষয়ে বিক্রমাসিংহের ক্ষমতা সামান্যই দেখা যাচ্ছে।

দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে তিনি সরকার এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মধ্যে সাম্প্রতিক চুক্তির শর্ত মেনে ভর্তুকি হ্রাস করেছেন, সরকারি সম্পদের বেসরকারীকরণ করেছেন এবং শ্রম নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে কঠোর অভিযান শুরু করছেন। এতে দেশ আবারও অস্থিরতার দিকে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

এ কারণে বিক্রমাসিংহেকে শুধু বিদায় নিলেই হবে না, কার্যনির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদও বিলুপ্ত করতে হবে। যতক্ষণ তা করা হবে না, ততক্ষণ শ্রীলঙ্কা উৎপীড়ক-প্রেসিডেন্টদের দ্বারা নিষ্পেষিত হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

পাসান জয়াসিংহে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন পিএইচডি ডিগ্রি প্রার্থী