এক বিপদে অসহায়, বড় বিপর্যয়ে কী হবে

আমরা একটা মহাবিপর্যয়ের লালসংকেতের মুখে আছি।
ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গবাজারে আগুনের ভয়াবহতা প্রচারমাধ্যমে যখন দেখছিলাম, ভয়ে আতঙ্কে তখন অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের ফায়ার ইউনিটগুলো একযোগে কাজ করছিল। কাজ করছিল সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি পুলিশ, র‌্যাব, বেসামরিক নিরাপত্তা বিভাগ। আকাশে উড়ছিল হেলিকপ্টার, তা থেকেও পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা হয়েছে। টেলিভিশনে লেখা উঠছিল, সমন্বয় করছেন প্রধানমন্ত্রী। তারপরও আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই, লেলিহান শিখা আশপাশের ভবনগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, এই আগুন বুঝি আর নেভানো যাবে না!

বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে আগুন নিভে আসে। অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর প্রাণান্তকর চেষ্টায় আশপাশের ভবনে আগুনের ছড়িয়ে পড়া রোধ করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়! হাজার হাজার মানুষের জীবিকা, সারা জীবনের সঞ্চয়, সারা বছরের ব্যবসা, হাজারো পরিবারের বর্তমান ভবিষ্যৎ এক প্রহরেই ছাই হয়ে গেছে জ্বলেপুড়ে।

মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে যায়।

একটা করে দুর্ঘটনা ঘটবে, তারপর আমরা বলব, এই ভবনের অনুমতি ছিল না, এই বাসের ফিটনেস ছিল না, এই এলাকায় রাসায়নিক রাখার কথা নয়, এই বাজার আগেই বিপজ্জনক বলে ঘোষিত ছিল। এখন যেমন আমরা বলছি, ঢাকায় পুকুর, হ্রদ, জলাশয়গুলো গেল কোথায়?

এর আগে সিদ্দিকবাজারে একটা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে, সম্ভবত গ্যাস থেকে। ৭ মার্চ ২০২৩। সে সময়ও আমরা বুঝতে পারি, দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি, সরঞ্জাম, রসদ, যন্ত্রপাতি কত অপর্যাপ্ত। মাত্র একটা ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। একই অসহায়ত্ব আমরা বোধ করেছিলাম কিছুদিন আগে, যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে।

এ থেকে যে দুশ্চিন্তা মনে হানা দেয়, তা হলো, একটা জায়গায় আগুন লাগলে, একটা ভবনে বিস্ফোরণ হলে আমরা সামলাতে পারি না। উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে বুঝতে পারি, আমাদের সীমাবদ্ধতা কত সীমাহীন। সে ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ, আল্লাহ না করুন, যদি এ ঢাকা শহরে কখনো আঘাত হানে, আমরা কী করব?

আমরা জানি, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের শঙ্কার মুখে আছে। গত ৪ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ইফতেখার মাহমুদের প্রতিবেদন, ‘দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূগর্ভস্থ ফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে ওই কম্পন হতে পারে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা।

‘সব এলাকাই ঢাকা থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেখানে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা ঢাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।’

আমরা যে একটা বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে আছি, দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় তা উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার বহু ভবন শুধু বিধ্বস্ত হবে, তা-ই নয়, আসল ক্ষতিটা হবে আগুন থেকে। আমাদের ভবনে ভবনে গ্যাসের লাইন, মুহূর্তে পুরো শহর জ্বলে উঠবে। এখন হরর মুভির মতো দৃশ্য কল্পনা করুন। একটা রানা প্লাজা ধসের সময় আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেও কত সামান্যই করতে পেরেছিলাম, একটা সিদ্দিকবাজারের সময় আমরা কতটা অসহায় বোধ করেছিলাম, এক বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে আমাদের কতটা বেগ পেতে হয়েছিল। এখন যদি একসঙ্গে ১ হাজার রানা প্লাজা ভেঙে পড়ে, একসঙ্গে যদি ১০০ বঙ্গবাজার জ্বলে ওঠে, একসঙ্গে যদি ৫০০ সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরিত হয়, এ শহরের হবেটা কী!

আপনারা ভাবছেন, আমি কেন বলছি যে এতগুলো ভবন একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি আসলে কমিয়ে বলছি। বিবিসি বাংলার ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর খবরটা পড়ুন—‘২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।...

‘এ ছাড়া উদ্ধার কাজের সহায়তার জন্য ২০১৯ সালে ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে আরও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ হাতে পাবে। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে ২৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, ‘ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল।’

এখন বুঝুন, বাস্তবতাটা! এক সিদ্দিকবাজার, এক সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা, এক বঙ্গবাজারের বিপর্যয় আমরা সামলাতে পারি না। বঙ্গবাজারে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের জন্য প্রধান বাধা হয়ে উঠেছিল মানুষের ভিড়। মানুষের ভিড়ে গাড়িগুলো চলতে পারছিল না, কর্মীরা কাজ করতে পারছিলেন না। কোথায় আমাদের ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি! ২০১৭ সালের চ্যানেল আই অনলাইন খবর থেকে জানা যায়, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘ভূমিকম্প আমি প্রস্তুত’ শিরোনামে প্রচারণার লোগো উন্মোচন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল। সে সময় ৬০ কোটি টাকার তাঁবু, ২৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনাসহ ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারের কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়।
তাঁবুগুলো কই? তা দিয়ে কী হচ্ছে?

আমরা আমাদের শহরটিকে পরিকল্পনার মধ্যে আনব না, আমরা আমাদের জলাশয়গুলো ভরাট করব, ডিএপি মানব না, ভবন বানানোর সময় মাটি নিরীক্ষা করব না, ভূমিকম্প ও দুর্যোগসহনীয় ভবন বানাব না, জরুরি নির্গমন পথ রাখব না, অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলার পথ রাখব না, গলিগুলো বানিয়ে রাখব অপ্রবেশ্য, আগুন নেভানোর যন্ত্র রাখব না, নিরাপত্তা নির্দেশিকা মানব না; আমাদের রাস্তায় একটাও ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকবে না, আমরা ফায়ার ড্রিল করব না, আমরা ঘনবসতির এলাকায় বিস্ফোরক রাখব, রাসায়নিক রাখব; আমাদের মার্কেটগুলোকে আমরা একেকটা বিপজ্জনক ফাঁদ বানিয়ে রাখব; আমরা কোনো নিয়মকানুন মানব না; আমাদের কারখানাগুলো কেউ পরিদর্শন করবেন না, ভবনগুলো কেউ নজরদারিতে রাখবেন না এবং আশা করব, দুর্যোগ এলে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা আমাদের রক্ষা করবেন এবং ভবন ভেঙে গেলে আমরা ৬০ কোটি টাকার তাঁবুতে থাকব!

আসলে আমরা একটা সার্বিক নিয়মহীনতার মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের অর্থগৃধ্নুতা সব নিয়মকানুন তছনছ করে ফেলেছে। লোভের লেলিহান শিখাই পুড়িয়ে ফেলছে সব প্রতিষ্ঠান, নিয়ম, নির্দেশিকা, ম্যানুয়াল, প্রটোকল, আইনকানুন, সুশাসন বলতে যা বোঝায়, তা থেকে আমরা সহস্র যোজন দূরে।

একটা করে দুর্ঘটনা ঘটবে, তারপর আমরা বলব, এই ভবনের অনুমতি ছিল না, এই বাসের ফিটনেস ছিল না, এই এলাকায় রাসায়নিক রাখার কথা নয়, এই বাজার আগেই বিপজ্জনক বলে ঘোষিত ছিল। এখন যেমন আমরা বলছি, ঢাকায় পুকুর, হ্রদ, জলাশয়গুলো গেল কোথায়?

আমরা একটা মহাবিপর্যয়ের লালসংকেতের মুখে আছি। এখন প্রকৃত আশাবাদীর পক্ষে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই নেই। অরুন্ধতী রায় ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ শেষ করেছেন এভাবে, ‘একটা গুবরে পোকা চিৎ হয়ে আকাশের দিকে পা উঁচু করে আছে। আকাশটা যদি ভেঙে পড়ে, সে পাগুলো দিয়ে ঠেকাবে।’ বনানীর আগুনের সময় একটা ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। দমকলের ফুটো পাইপ পলিথিনে পেঁচিয়ে হাত দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে একটি শিশু। পরে শিশুটিকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এবারও এমন একটি ছবি দেখলাম। জানি না ছবিটা কার তোলা, এবারের নাকি আগেরবারের।

এই গুবরে পোকাটা আকাশের ভেঙে পড়া ঠেকাতে পারবে না। তবু সে চেষ্টা করছে। বঙ্গবাজারে লুটপাট করা, দমকল অফিসে হামলা করা, রাস্তায় ভিড় করে বাধা তৈরি করা জনতার বিপরীতে এই শিশুই আমাদের আশা জোগায়।

যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই নৈরাজ্যের স্রোতের বিপরীতে নিয়মকানুন, আইনের শাসন, সুশাসন, নিরাপত্তা বিধান ও পদক্ষেপ নেওয়ার কাজটা আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। যদি আমরা ব্যর্থ হই, তবু আমাদের চেষ্টা ছাড়া যাবে না।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক