চট্টগ্রামবাসী এমন শহীদ মিনার চায়নি

‘মিলনায়তন ও গ্রন্থাগারের সঙ্গে শহীদ মিনারকে যুক্ত করতে গিয়ে সড়কের ওপর নির্মিত এই ওভারব্রিজ শহীদ মিনারটিকে ঢেকে ফেলেছে। সেটি আর নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে না।’
‘মিলনায়তন ও গ্রন্থাগারের সঙ্গে শহীদ মিনারকে যুক্ত করতে গিয়ে সড়কের ওপর নির্মিত এই ওভারব্রিজ শহীদ মিনারটিকে ঢেকে ফেলেছে। সেটি আর নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে না।’

চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ মহান বিজয় দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতবারও মহান ভাষা দিবস ও বিজয় দিবসে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণের বিকল্প অস্থায়ী শহীদ মিনারে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। সে সময় শহীদ মিনার বিনির্মাণের কাজ চলছিল।

এ বছর অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। শহীদ মিনার তৈরির কাজ শেষ। তবে নতুন সাজের শহীদ মিনার চট্টগ্রামবাসীকে হতাশ করেছে। চট্টগ্রামের নন্দন কাননে কে সি দে সড়কের এক পাশে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চারপাশে সবুজ বাগান ছিল। এখন নতুন শহীদ মিনার ইটপাথরের অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়েছে।

অথচ চট্টগ্রামের মানুষের জন্য এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো দাবিদাওয়া আদায় করতে মানুষ এখানে এসে জড়ো হয়, প্রগতিশীল যেকোনো আন্দোলনের সূচনা হয় এখান থেকেই। কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা কবি সাংবাদিক, সাহিত্যিকের মৃত্যু হলে এখানে মৃতদেহ এনে সম্মান জানানো হয়। এখন এখানে এমন অবকাঠামো করা হয়েছে যে সেগুলো করার আর কোনো জায়গা থাকল না। কঠিন ইটপাথরের অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়ে গেল আমাদের ঐতিহ্যের, আমাদের চেতনার শহীদ মিনার। চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ এ নিয়ে ক্ষুব্ধ।

কে সি দে সড়কের এক পাশে যে পাহাড়ের ওপর শহীদ মিনার অবস্থিত, তারই আরেক পাশে বিভাগীয় গ্রন্থাগার ও মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তন। গ্রন্থাগার ও মিলনায়তনের সামনে আগে খোলা প্রাঙ্গণ ছিল। গ্রন্থাগার, মুসলিম ইনস্টিটিউট ও শহীদ মিনারের মাঝখানের এই প্রাঙ্গণ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সমাজের মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ।

৯৯ বছর বয়সী চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনকে ঘিরে চট্টগ্রামে সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে নানা সংগ্রাম, আন্দোলনের সাক্ষী এই মুসলিম মিলনায়তন এবং শহীদ মিনার।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর যখন স্বাধীনতার সব মূল্যবোধ একে একে মুছে যাচ্ছিল, যখন ইতিহাসের রথের চাকা উল্টো দিকে চলছিল, যখন মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ ছিল, সামরিক শাসনের জাঁতাকল পিষে মরছিল গণতন্ত্র, তখন ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের সামনে হাজারো মানুষ মিলিত হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাত। শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে গ্রন্থাগারের সামনে প্রতিবছর বসত বইমেলা। চট্টগ্রামের বইমেলা এখান থেকেই শুরু। এসব কারণে শহীদ মিনার, মুসলিম হল, বিভাগীয় গ্রন্থাগার বিশেষ মর্যাদাসহ ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে।

স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। গ্রন্থাগারের পরিসর বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনকেও যুগোপযোগী করা দরকার ছিল। এসব দাবি উঠেছিল সাংস্কৃতিক কর্মী ও সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকেই। সময়ের দাবিকে মান্য করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় গ্রন্থাগার, মিলনায়তন এবং রাস্তার ওপারের শহীদ মিনারের সংস্কারের কাজ নেয় একই প্রকল্পের অধীন।

এ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রামবাসীর শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ওপর। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় এ প্রকল্পের কাজ। শুরুতে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৩২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে এটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮১ কোটি ৩৯ কোটি টাকা।

এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে শহীদ মিনার ও গ্রন্থাগারের মাঝখানের কে সি দে সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এটি বন্ধই রয়েছে। ব্যস্ত জনবহুল এই এলাকায় একটি সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রাইফেল ক্লাব ও অপর্ণাচরণ স্কুলের সামনে তখন থেকে দিনরাত যানজট লেগেই আছে। বছরের পর বছর এই যন্ত্রণা মানুষ সহ্য করেছে শহীদ মিনার ও মিলনায়তন সংস্কারের স্বার্থে।

সেই সংস্কারের কাজ এখন প্রায় শেষের পথে। নতুন নির্মিত আটতলা মুসলিম ইনস্টিটিউটে ৯০০ আসনের মিলনায়তন এবং ৩৫০ আসনের মিনি মিলনায়তন রয়েছে। এখানে দুটি সেমিনার কক্ষ রয়েছে। রয়েছে একটি আর্ট গ্যালারি ও স্যুভেনির শপ। নবনির্মিত ১৫ তলা পাবলিক লাইব্রেরিতে একসঙ্গে মোট দেড় হাজার পাঠক বসে পড়তে পারবেন। আছে একটি বড় ও একটি ছোট সেমিনার কক্ষ। পুরোনো শহীদ মিনারকেও বিনির্মাণ করা হয়েছে। চেহারা আগের মতো, তবে আকৃতি বড়। এখানে রয়েছে উন্মুক্ত গ্যালারি।

সংস্কার মানে কোনো একটি অবকাঠামোকে যুগোপযোগী করা। সংস্কার মানে ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে অবহেলা নয়। এই সংস্কারে চট্টগ্রামের শহীদ মিনারের ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। চট্টগ্রামের মানুষের দাবি, শহীদ মিনারের সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা হোক।

সবই আছে, শুধু শহীদ মিনারের সামনে কোনো উন্মুক্ত জায়গা নেই। সুরম্য-সুদৃশ্য গ্রন্থাগার ও মিলনায়তনের সামনে কোনো খোলা জায়গাও নেই। তার বদলে গ্রন্থাগার ও মিলনায়তন ঘিরে যে কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে ২১ ফুট উঁচু একটি ওভারব্রিজ করা হয়েছে। মিলনায়তন ও গ্রন্থাগারের সঙ্গে শহীদ মিনারকে যুক্ত করতে গিয়ে সড়কের ওপর নির্মিত এই ওভারব্রিজ শহীদ মিনারটিকে ঢেকে ফেলেছে। সেটি আর নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে না। সামনের সড়কটিও হয়ে গেছে সুড়ঙ্গের মতো। নতুন নকশার শহীদ মিনারের চারদিকে উঁচু দেয়াল। তার কারণে পাশ থেকেও শহীদ মিনার দেখা যাচ্ছে না। এখন শহীদ মিনার দেখতে হলে সিঁড়ি বেয়ে ২১ ফুট ওপরে উঠে দেখতে হবে।

শহীদ মিনারকে কেন গ্রন্থাগার ও মিলনায়তনের সঙ্গে এমন সংযোগ করতে হলো, সেটার উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। কেন একটি সাধারণ স্বাভাবিক সড়ককে বিনা প্রয়োজনে সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলা হলো, সেটিও বুঝতে পারছে না চট্টগ্রামের মানুষ। কাজ প্রায় যখন শেষ, নতুন নির্মিত অবকাঠামো যখন দৃশ্যমান, তখন চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ঐতিহ্যের শহীদ মিনার।

এ নিয়ে ২ ডিসেম্বর নবনির্মিত গ্রন্থাগারের একটি কক্ষে চট্টগ্রামের সব শ্রেণি-পেশার সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ এক বৈঠকে বসেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় যে তাঁরা এমন শহীদ মিনারে ফুল দেবেন না। তাঁরা সংস্কার চেয়েছিলেন শহীদ মিনারের। কিন্তু মাটি থেকে দোতলায় উত্তরণ চাননি। এই শহীদ মিনারে ফুল দিতে হলে দোতলার চেয়ে উঁচু অবকাঠামোয় উঠতে হবে।

যেকোনো স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলতে চারপাশে সবুজ রাখতে হয়। এখানে সেটি নেই। শহীদ মিনারের চারপাশে এখন কারাগারের মতো সব প্রাচীর। গ্রন্থাগারটির নকশাও সুন্দর হয়েছে। শুধু খোলা জায়গা না থাকার কারণে গ্রন্থাগারের সৌন্দর্যহানিও হয়েছে।

সংস্কৃতিকর্মীদের মনে ক্ষোভ ও হতাশা দেখে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ২ ডিসেম্বর এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। সেখানে প্রত্যেকে সড়ক থেকে দৃশ্যমান একটি শহীদ মিনার চান। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা এই শহীদ মিনারে যাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আরও বলেন, নবনির্মিত মুসলিম ইনস্টিটিউট ও গণগ্রন্থাগার ভবনের সঙ্গে শহীদ মিনারকে যুক্ত করা ২১ ফুট উঁচু প্লাজার কারণেই এমনটা ঘটেছে। তাঁরা সবাই এই প্লাজা ভেঙে ফেলার দাবি তোলেন। মেয়রও সবার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

মতবিনিময় সভায় প্রফেসর অনুপম সেন, কবি আবুল মোমেন, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দারসহ কবি, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, নৃত্যশিল্পী, আবৃত্তিকার, সাংস্কৃতিক সংগঠকেরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সড়কের ওপর নির্মিত সেতুর মতো প্লাজা ভেঙে শহীদ মিনার দৃশ্যমান না করা পর্যন্ত তাঁরা নিয়মিত বৈঠক করবেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবেন। প্রয়োজনে আন্দোলনে নামবেন।

সংস্কার মানে কোনো একটি অবকাঠামোকে যুগোপযোগী করা। সংস্কার মানে ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে অবহেলা নয়। এই সংস্কারে চট্টগ্রামের শহীদ মিনারের ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। চট্টগ্রামের মানুষের দাবি, শহীদ মিনারের সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা হোক। নিকট অতীতে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতের মানুষের অনেক দাবি এই সরকার মেনে নিয়েছে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না বলে তাঁদের বিশ্বাস।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক