প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ২০ জুলাই প্রথম আলোতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহকর্মী রিয়াদুল করিম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী যেসব প্রশ্ন করেছেন, তার অনেকটাই সাক্ষাৎকারদাতা এড়িয়ে গেছেন। আর যেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তা–ও এতটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন যে তা থেকে প্রকৃত সত্য বের করা কঠিন। অনেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘দেখুন, অপেক্ষা করুন।’ তিনি দীর্ঘদিন আইনসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর কথায় আইনের মারপ্যাঁচ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
সিইসির কাছে প্রশ্ন ছিল, বিএনপিসহ অনেকগুলো দল আপনার নেতৃত্বাধীন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সব দলের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবেন?
জবাবে সিইসি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদ্যমান সরকারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর সব দলের আস্থা ফিরে আসবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আমরা সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের আলোকে নির্বাচন বিষয়ে আমাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও বিধিবিধান অনুযায়ী চলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কথা হলো এই সংবিধান ও বিধিবিধানের ব্যাখ্যা কে কীভাবে করবেন? নির্বাচন তো প্রতিনিধি বাছাই করার উন্মুক্ত সুযোগ। নির্বাচন কমিশনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সেই সুযোগ করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, সেগুলো অপসারণ করা। সংবিধান ও বিধিবিধান রক্ষা করতে গিয়ে জনগণকে প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি কমিশনও নয়, রাজনৈতিক দলও নয়, নিয়ামক শক্তি হলো জনগণ। সেই জনগণ বা জনগণের কোনো অংশকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হতে পারে না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরপিও সংশোধনের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন, তার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না। তিনি বলেছেন, ভোট যদি অনুষ্ঠানই না হয়ে থাকে, সেটি স্থগিত হবে কীভাবে? কিন্তু নির্বাচন তো কেবল ভোট গ্রহণ নয়, তার আগে ও পরের অবস্থাও বিবেচনায় নিতে হবে। যদি দেখা যায়, তফসিল ঘোষণার পর কোনো দল তাদের মনোনীত প্রার্থী ছাড়া অন্য কাউকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দিল না, তখন কমিশন কি সেটাকে বৈধতা দিয়ে ফল ঘোষণা করে দেবে, না নতুন করে তফসিল দেবে?
১৯৯১ সালে বিচারপতি রউফের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রেখে যাওয়া সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল বলে দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও স্বীকার করেছেন। আবার পরিবর্তিত অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংবিধান ও বিধিবিধানের আওতায় ওই কমিশন ১৯৯৪ সালে মাগুরায় যে উপনির্বাচন করেছিল, সেটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বর্তমানে দেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সংকট, তার সূচনা মাগুরা উপনির্বাচন থেকেই।
সাক্ষাৎকারে প্রথম আলো তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যেকোনো একটি দল নির্বাচন বর্জন করলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য বলা যাবে কি না? সিইসির জবাব, ‘অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্যতার কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করা নেই। তাই বলতে পারছি না।’
পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম। তিনি আগে এ প্রশ্নের ভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের সঙ্গে এক মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে বড় দুই দলের অনড় অবস্থান দেশের জন্য বিপজ্জনক। এই অনড় অবস্থানের মধ্যে নির্বাচন হলে এবং কোনো বড় দল নির্বাচনে অংশ না নিলে ফলাফলের ওপর ঝুঁকি থাকতে পারে। একটি আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, মানুষ বিপদগ্রস্ত হতে পারে।
মানুষ তার কোন কথাটি বিশ্বাস করবে? বড় দুই দলের অনড় অবস্থান দেশের জন্য যে বিপজ্জনক, তার আলামত ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। সিইসি যখন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মানদণ্ড নেই বলে মন্তব্য করেছেন, তখন প্রধান দুই দল রাজপথে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। ১৮ ও ১৯ জুলাই বিএনপির পদযাত্রার বিপরীতে আওয়ামী লীগ শান্তি শোভাযাত্রা করেছে। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরে কৃষক দলের কর্মী নিহত ও সারা দেশে কয়েক শ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর বরিশাল জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার পরও সিইসি বলেছিলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করুক। বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না।’ কোনো দলকে কমিশন জোর করে নির্বাচনে আনতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে অপূর্ণতা থেকে যাবে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। (প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর ২০২২)
এর আগে গত বছর জুলাই মাসে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে খেলাফত মজলিসের সংলাপের শুরুতে সিইসি বলেন, বিএনপি অংশ না নিলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। তাঁর ভাষায়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ।
আমরা যতটা মনে করতে পারি, কেবল এই তিন উপলক্ষ নয়, সিইসি প্রায় প্রতিটি বৈঠক ও মতবিনিময় সভায় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন।
তাঁর সহকর্মী কমিশনাররাও একই কথা বলেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর আউয়াল কমিশনের পদাধিকারীরা অন্তত কথাবার্তায় দেখাতে চেয়েছিলেন যে তাঁরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চান। অন্তত গাইবান্ধা উপনির্বাচনে তারা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তাতে কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল।
বিএনপির সঙ্গে একাধিকবার আলোচনার উদ্যোগও নির্বাচন কমিশন নিয়েছিল। সেই উদ্যোগ সফল হয়নি বিএনপির অনড় মনোভাবের কারণে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক অবস্থান যা–ই হোক না কেন, বিএনপির উচিত ছিল নির্বাচন কমিশনের আহ্বানে সাড়া দেওয়া। বিএনপির নেতারা তাঁদের এক দফার দাবিটি নির্বাচন কমিশনে গিয়ে জানিয়ে আসতে পারতেন। জনসভা করার জন্য যদি তাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারের ঢাকার পুলিশ কমিশনার বা তঁার অধস্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসতে পারেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি থাকবে কেন?
নির্বাচন কমিশন তো বিএনপির একটি দাবি মেনে নিয়েছে। বিএনপি বলেছিল, ইভিএমে ভোট করা চলবে না, ব্যালটেই ভোট হতে হবে। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন ইভিএমের বদলে ব্যালটে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরপিও সংশোধনের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন, তার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না। তিনি বলেছেন, ভোট যদি অনুষ্ঠানই না হয়ে থাকে, সেটি স্থগিত হবে কীভাবে? কিন্তু নির্বাচন তো কেবল ভোট গ্রহণ নয়, তার আগে ও পরের অবস্থাও বিবেচনায় নিতে হবে। যদি দেখা যায়, তফসিল ঘোষণার পর কোনো দল তাদের মনোনীত প্রার্থী ছাড়া অন্য কাউকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দিল না, তখন কমিশন কি সেটাকে বৈধতা দিয়ে ফল ঘোষণা করে দেবে, না নতুন করে তফসিল দেবে? নতুন তফসিল ঘোষণার অর্থ আগের নির্বাচনপ্রক্রিয়া বাতিল হওয়া। এর জন্য ভোটের দিন বা পোলিং পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
তবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ধন্যবাদ দেব। তিনি তঁার পূর্বসূরির মতো বাংলাদেশি নির্বাচনী মডেল বিদেশে রপ্তানি করার কথা বলেননি। তিনি নির্বাচনে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে জনগণ তার প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
এখন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনকেই ঠিক করতে হবে তাঁরা বিধিবিধান রক্ষার নির্বাচন করবেন, না জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উন্মুক্ত সুযোগ করে দেবেন?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com