গ্লোবাল সাউথ আদতে একটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক স্লোগান। গ্লোবাল সাউথকে কেউই আর ভৌগোলিক অর্থে নেয় না।
গ্লোবাল সাউথ আদতে একটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক স্লোগান। গ্লোবাল সাউথকে কেউই আর ভৌগোলিক অর্থে নেয় না।

পুতিন–সি চিন পিংয়ের গ্লোবাল সাউথ বিস্ময় জাগাচ্ছে

‘গ্লোবাল সাউথ’-এর বাংলা অনুবাদ ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ’ হতে পারে, কিন্তু এই অনুবাদ দিয়ে কিছু বোঝা যাবে না। গ্লোবাল সাউথ এখন বহুল উচ্চারিত একটি শব্দবন্ধ, যা ইদানীং রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নবিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ইত্যাদি সবারই মুখে মুখে। অতএব গ্লোবাল সাউথ বলতে কী বোঝায়, আমাদের জানা দরকার। আবার যেহেতু বহুল উচ্চারিত, নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ এর ধারণা ও ভূমিকা।

ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ গোলার্ধভুক্ত ৩২টি উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে গ্লোবাল সাউথ গঠিত। দেশগুলো উচ্চতর অক্ষাংশের এবং বিষুবরেখার নিচে। এর মধ্যে আছে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, ইসরায়েল এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া এশিয়ার বাকি দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল।

দেখা যাচ্ছে, গ্লোবাল সাউথে অন্তর্ভুক্ত কিছু দেশ যেমন চীন, ভারত ও আফ্রিকার উত্তর অংশ পড়েছে উত্তর গোলার্ধের ভেতরে। আবার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ গোলার্ধভুক্ত হলেও গ্লোবাল সাউথে ধরা হয় না।

সবচেয়ে বেশি ভূমি রয়েছে উত্তর গোলার্ধে, বিশ্ব জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ এখানে, কিন্তু সম্পদের ৮০ শতাংশ এই দেশগুলোর দখলে। দক্ষিণ গোলার্ধভুক্ত ইকুয়েটরিয়াল তথা নিরক্ষীয় দেশগুলো যারা মূলত কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, উত্তর গোলার্ধের উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলোর চেয়ে, তারা উন্নয়নের সব সূচকেই পিছিয়ে।

ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোর অবস্থান ছিল মূলত দক্ষিণ গোলার্ধে আর উত্তর গোলার্ধে ছিল উপনিবেশকারীদের বাস। অনেক দিন হলো, উপনিবেশ আর নেই, কিন্তু গ্লোবাল সাউথ এখনো মনে করে, তারা গ্লোবাল নর্থ দ্বারা অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে প্রতারণার ও বঞ্চনার শিকার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সব বিশ্ব সংস্থার নীতি পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা মেলে।

গ্লোবাল সাউথের নেতারা মনে করেন, তাঁরাই বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি। অবশ্য এমন দাবি বৈধতা পেতে পারে আমরা যদি উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত ও দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ চীনকে গ্লোবাল সাউথের গণ্য করি। উল্লেখ্য, ভারত ও চীন—উভয়ই গ্লোবাল সাউথের নেতা হওয়ার দৌড়ে আছে এবং তারা ইতিমধ্যেই এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে।

গ্লোবাল সাউথকে ১৯৬১ সালে গঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তথা ন্যাম-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। শীতল যুদ্ধের সময় যেসব দেশ মার্কিন বা সোভিয়েত—এর কোনো জোটেই থাকতে চায়নি, তাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, যার নেতা ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান স্থপতি কৃষ্ণ মেনন, যুগোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের, ঘানার প্রেসিডেন্ট নক্রুমাহ, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনভুক্ত দেশগুলোই একসময় ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে পরিচিতি পায়।

এদের উদ্দেশ্য ছিল শীতল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করা। প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন দশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। যেমন উপনিবেশমুক্তকরণ, স্বাধীন দেশের জন্ম, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতান্ত্রিকরণ ইত্যাদি। ন্যাম বর্তমানে দুর্বল হলেও এখনো ১২০টি দেশ এর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত।

গ্লোবাল সাউথ আদতে একটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক স্লোগান। গ্লোবাল সাউথকে কেউই আর ভৌগোলিক অর্থে নেয় না। অনেকটা জি৭৭-এর মতো। ১৩৫টি দেশ নিয়ে গঠিত এই জোট উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমন্বিত অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষারই চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এই গ্রুপকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারছেন।

প্রেসিডেন্ট পুতিন পশ্চিমাদের আরোপ করা নজিরবিহীন অবরোধ পাশ কাটিয়ে গ্লোবাল সাউথভুক্ত দেশগুলোয় তার পণ্য রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টিতে বা বিরাজমান বাজার সম্প্রসারণে পুরোপুরি সফল। ভারত, চীন, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়া ইত্যাদি অনেক দেশ, রাশিয়া থেকে ব্যাপক মাত্রায় আমদানি করেছে। এর একটি বিরাট অর্থ আছে।

নর্থ-সাউথ তথা উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনের আরেকটা দিক হলো জলবায়ু সমস্যা। উত্তরের শিল্পোন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে, বাতাসে কার্বন নির্গমন করে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে, সব প্রজাতির জীবন ধারণ অসম্ভব করে অপরিমেয় ক্ষতি সাধন করছে, যার প্রধান শিকার গ্লোবাল সাউথ।

শিল্পোন্নত গ্লোবাল নর্থ এভাবে মুনাফার পাহাড় গড়ছে। পক্ষান্তরে কৃষিপ্রধান গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর শস্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে এবং এভাবে অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে তারা। কিন্তু বিনিময়ে গ্লোবাল নর্থ কার্বন নির্গমন কমানোর ও গ্লোবাল সাউথের ক্ষতিপূরণের জন্য তেমন কিছুই করছে না। করলেও তা যৎসামান্য।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে প্রাথমিকভাবে গঠিত ব্রিকসের মধ্য থেকে চীন ও ভারত গ্লোবাল সাউথের নেতা হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু চীন আবার মার্কিনদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠছে, কারণ অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তির উল্লম্ফন, অত্যাধুনিক অবকাঠামো তাদের পরাশক্তির মর্যাদা দিয়েছে।

তবু মজার ব্যাপার হলো, গ্লোবাল সাউথের নেতা হওয়ার জন্য নিজেকে উন্নত দেশ হিসেবে দেখানোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উপস্থাপন করছে। গ্লোবাল সাউথের নেতা হওয়া আর এই জোটের কণ্ঠ উচ্চে তুলে ধরাই এখানে মূল লক্ষ্য।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে গ্লোবাল সাউথ ঘিরে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। রাশিয়া নতুন করে গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পশ্চিমাদের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞায় ও অবরোধে রাশিয়ার অর্থনীতি যখন পঙ্গু হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে, তখন বিরাজমান বাজারের সম্প্রসারণ ও নতুন বাজারের সন্ধান করার জন্য গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে বেছে নিয়েছে দেশটি।

সমরাস্ত্র, তেল, পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি সবকিছুর বাজার তারা পেয়েছে এখানেই। ধস নামার পরিবর্তে, আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়েও বেশি হারে রাশিয়ার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়াও আদর্শিকভাবেও রাশিয়া গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করছে।

ইউক্রেন আক্রমণকে ঘিরে রাশিয়া একটি নতুন ন্যারেটিভ তথা উপাখ্যান নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এটাকে তারা বলছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, মার্কিন ও পশ্চিমা আধিপত্যবাদবিরোধী যুদ্ধ। নতুনভাবে নির্মিত সেই উপাখ্যানে এ যুদ্ধ প্রতিরক্ষামূলক এবং প্রতিরোধমূলক, যা তাদের অস্তিত্বের লড়াই।

শীতল যুদ্ধের সময় গঠিত ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণ শুধু নয়, এর অস্তিত্ব নিয়েও মানুষ প্রশ্ন তুলছে, যা খুবই যৌক্তিক। তার চেয়েও বেশি যৌক্তিক ইউক্রেনে ন্যাটোর সম্প্রসারণে রাশিয়ার নিরাপত্তার শঙ্কা। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ প্যাক্টের অবসান হয়, তখন রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ন্যাটোর আর কোনো সম্প্রসারণ ঘটবে না।

ইউক্রেনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই এই যুদ্ধের জন্য দায়ী, গ্লোবাল সাউথভুক্ত দেশগুলো, ভূতপূর্ব কলোনিগুলো রাশিয়া প্রদত্ত এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে। প্রমাণ, ইউক্রেন আক্রমণের পরপরই পুতিন রাশিয়ায় আফ্রিকার দেশগুলোর এক সম্মেলন আয়োজন করেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু বাণিজ্য চুক্তিও সম্পাদিত হয়।

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেখানেও গ্লোবাল সাউথ খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। গ্লোবাল সাউথ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার যখন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে চতুর্থবারের মতো ভেটো প্রদান করেছে।

এতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় মার্কিনবিরোধী মনোভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমের অন্য সব নেতা যখন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা থেকে বিরত, তখন এগিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট সি। এই মোক্ষম সময়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে গ্লোবাল সাউথের নেতা হওয়ার সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। পুতিন ইতিমধ্যেই রাশিয়ায় ফিলিস্তিনসহ আরব নেতাদের সম্মেলন ডেকেছেন।

প্রেসিডেন্ট পুতিন পশ্চিমাদের আরোপ করা নজিরবিহীন অবরোধ পাশ কাটিয়ে গ্লোবাল সাউথভুক্ত দেশগুলোয় তার পণ্য রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টিতে বা বিরাজমান বাজার সম্প্রসারণে পুরোপুরি সফল। ভারত, চীন, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়া ইত্যাদি অনেক দেশ, রাশিয়া থেকে ব্যাপক মাত্রায় আমদানি করেছে। এর একটি বিরাট অর্থ আছে।

এর অর্থ হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে গ্লোবাল সাউথ, পশ্চিমাদের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ন্যাটোর সম্প্রসারণই যে পুতিনের ‘বিশেষ মিলিটারি অপারেশন’-এর মূল কারণ—এই পুতিনীয় ব্যাখ্যা তারা গ্রহণ করেছে।

মৃত্যুশয্যায় রাজনীতি বিষয়ে লেনিনের সর্বশেষ বাক্যগুলো ছিল এ রকম: ইউরোপে বিপ্লব অত সহজে ঘটবে না। কারণ, ইউরোপ উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিব্যাপ্ত। বিপ্লবের ভরকেন্দ্র চলে যাচ্ছে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে (যাকে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে গ্লোবাল সাউথ বলছি) অর্থাৎ পৃথিবীর উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশগুলোর দিকে, বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দিকে।

উপনিবেশী শক্তির তল্পিবাহক পুঁজিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব-দক্ষিণের উপনিবেশিত মানুষের সশস্ত্র বিদ্রোহে আমাদের শক্তি জোগাতে হবে। আমাদের বিপ্লব টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে চীন, ভারত ও অন্য সব উপনিবেশিত মানুষের বিপ্লব করার সক্ষমতার ওপর। কারণ, পৃথিবীজুড়ে বিপ্লব না হলে, কোনো একক দেশের বিপ্লব ধরে রাখা যায় না।  

তিনিই যথার্থ বিপ্লবী, যিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। লেনিনের দূরদর্শিতা কল্পনাকেও হার মানায়। আমাদের বিস্ময় লাগে, যখন দেখি, লেনিনের দেশেরই একজন অ-কমিউনিস্ট নেতা তথা আজকের ভ্লাদিমির পুতিন, লেনিনের কথারই প্রতিধ্বনি করেন, পশ্চিমি দুনিয়ার সম্প্রসারণবাদী শক্তির মোকাবিলায় লেনিন-নির্দেশিত গ্লোবাল সাউথের পথে হেঁটে যান বহু দূর।

ড. এন এন তরুণ, ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com