সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়েতে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে ভাড়া বৃদ্ধি না করে শুধু বিদ্যমান দূরত্বভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়েতে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে ভাড়া বৃদ্ধি না করে শুধু বিদ্যমান দূরত্বভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মতামত

যাত্রীভাড়া বাড়িয়ে রেলকে কি স্বাবলম্বী করা যাবে?

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনে শোভন চেয়ার ও এসি চেয়ার (স্নিগ্ধা) শ্রেণির ভাড়া ৫১০ ও ৯৭২ টাকা থেকে বেড়ে হবে যথাক্রমে ৬৪৫ ও ১ হাজার ২৩৭ টাকা। ঢাকা-রংপুর রুটে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে শোভন চেয়ার ও এসি চেয়ার (স্নিগ্ধা) শ্রেণির ভাড়া ৫০৫ ও ৯৬৬ টাকা থেকে বেড়ে হবে যথাক্রমে ৬৩৫ ও ১ হাজার ২১৪ টাকা। ঢাকা-চিলাহাটি রুটে চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে শোভন চেয়ার ও এসি চেয়ার (স্নিগ্ধা) শ্রেণির ভাড়া ৪৯৫ ও ৯৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হবে যথাক্রমে ৬২০ ও ১ হাজার ১৮৫ টাকা।

২২ এপ্রিল এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে জানিয়েছে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে দূরত্বভিত্তিক ও সেকশনভিত্তিক রেয়াতি দেওয়া হয়। ২০১২ সালে ‘সেকশনাল রেয়াত’ বাতিল করা হলেও দূরত্বভিত্তিক রেয়াত বলবৎ থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়েতে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে ভাড়া বৃদ্ধি না করে শুধু বিদ্যমান দূরত্বভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেনে বিদ্যমান দূরত্বভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি আগামী ৪ মে থেকে কার্যকর করা হবে।

বাংলাদেশে তা হলো না। উল্টো স্টেশনগুলোতে গোডাউনের পরিবহন লাইন উঠিয়ে দেওয়া হলো। অথচ জিডিপি বেড়েছে কয়েক গুণ। যদি রেলে পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়ে দ্বিগুণের কম বিনিয়োগ করে পাঁচ গুণ বেশি লোড বহন করা যায়, তাহলে পরিবহন খরচ কত কমে যেত!

২৫ বছর আগেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ছিল একটি লাভজনক সংস্থা। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে সংস্থাটি যে টাকা আয় করত, তা দিয়ে ট্রেন পরিচালনার সব ব্যয় মেটানোর পরও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকত। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর সংস্থাটিতে এমন উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, লাভজনক থেকে ক্রমেই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে রেল।

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে রেলের মোট লোকসান হয় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। লোকসানের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। ২৫ বছর আগে যেখানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো সংস্থাটিকে, সেখানে বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ের প্রধান খাত যাত্রী পরিবহন। মোট আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। অন্যদিকে সংস্থাটির মোট আয়ের ২০ শতাংশ আসে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে। জমি ইজারা, ক্যাটারিংসহ বিবিধ খাত থেকে আসে অবশিষ্ট আয়। বিপরীতে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত ইঞ্জিন-কোচ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ। 

একটি ট্রেনে কোন ধরনের কোচ কতটি থাকবে, তার ওপরও ট্রেনপ্রতি আয় নির্ভর করে। যদি জনপ্রিয় কোনো ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচের আসনবিন্যাস পরিবর্তন করে ৬৪ জনের জায়গায় ৮০ জনের করা যায়, তাহলে কোচপ্রতি আয় বাড়বে। এরপর আছে বগির সংখ্যা—বাংলাদেশে আমদানি করা ইঞ্জিনগুলো ২৫টি বগি বা কোচ নিয়ে চলতে সক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশে তা ১০-১২টি বগি নিয়ে চলাচল করে। অথচ বগির সংখ্যা বাড়ালে ট্রেনের আয় বাড়ে, কিন্তু খরচ প্রায় একই থাকে। কারণ রেললাইন, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক, প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদির অনেক খরচই বগির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

দুই.

মালামাল পরিবহনের জন্য রেলওয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরিবহন লাইনগুলো প্রায় উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় বেশি লোড বহন করলেও উভয়ে একই ড্রাইভার, রেললাইন, সিগন্যাল-ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহার করে। ফলে একটি মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি লোড বহন করলেও খরচ যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় দ্বিগুণের কম। টনপ্রতি হিসাব করলে খরচ আরও কম। রেলের চেয়ে সড়কপথে পরিবহন খরচ প্রায় তিন গুণ। এর বাইরে সড়ক বা সেতু টোলসহ আরও খরচ যুক্ত হয়ে ব্যয় আরও বাড়ে। ফলে পণ্যের দাম বাড়ে আর গরিব মানুষ দায় বহন করে।

সুধীর কুমার ও শাগুন মেহরোত্রার ব্যাংকরাপ্টসি টু বিলিয়নস: হাউ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ট্রান্সফরমড গ্রন্থে তাঁরা দেখিয়েছেন, ভারতে যাত্রীবাহী ট্রেনের প্রতি টন-কিলোমিটার খরচ ৭ রুপি হলেও মালবাহী ট্রেনের প্রতি টন-কিলোমিটার খরচ সেখানে মাত্র ৫১ পয়সা।

উৎপাদনকেন্দ্র থেকে ব্যবহারকেন্দ্রে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা, বিপুল পরিমাণ পণ্য একত্রে পরিবহনে ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে পরিবহনের ক্ষেত্রে রেলওয়ে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কথা। বাংলাদেশে তা হলো না। উল্টো স্টেশনগুলোতে গোডাউনের পরিবহন লাইন উঠিয়ে দেওয়া হলো। অথচ জিডিপি বেড়েছে কয়েক গুণ। যদি রেলে পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়ে দ্বিগুণের কম বিনিয়োগ করে পাঁচ গুণ বেশি লোড বহন করা যায়, তাহলে পরিবহন খরচ কত কমে যেত!

২০০১ সালে ভারতে টনপ্রতি মালবাহী ট্রেনের পরিবহন খরচ ছিল ৬১ পয়সা। ২০০৮ সালে তা ১২ শতাংশ কমে ৫৪ পয়সায় নেমে আসে। আর ২০০১ সালে লাভ ছিল ২১ শতাংশ আর ২০০৮ সালে তা বেড়ে হয় ৩৭ শতাংশ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছুদিন পরপর ট্রেনের যাত্রীভাড়া বাড়ানো হয়। প্রশ্ন হলো দিনের পর দিন যাত্রীভাড়া বাড়িয়ে রেলওয়েকে কি স্বাবলম্বী করা যাবে?

নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি

nahidknowledge1@gmail.com