দারুণ, যুগোপযোগী একটি শিক্ষাক্রম চালু করেও সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেও সমালোচনা ও বিতর্ক থামাতে পারছেন না।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে গাইড ব্যবসায়ী আর কোচিং ব্যবসায়ীদের আপত্তি আছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মানতে হবে, দেশের অভিভাবকদের বড় অংশ এই শিক্ষাক্রমকে গ্রহণ করতে পারছেন না। সমালোচনাকে বিবেচনায় নিয়ে এর জবাব খুঁজতে হবে। নইলে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার ধারণাটি অভিনব এবং পৃথিবীর খুব অল্পসংখ্যক দেশেই এটি চালু রয়েছে। এই শিক্ষাক্রম এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থী বাস্তব জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং অর্জিত শিক্ষাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে।
আগের শিক্ষাক্রমগুলোর মতো এখানেও শ্রেণি অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। তবে তা মূল্যায়ন করার বা পরীক্ষা নেওয়ার উপায়টি ঠিক আগের মতো নয়। ফলে গতানুগতিক গাইড বই শিক্ষার্থীদের কোনো সুবিধা দেবে না। এমনকি কোনো কোচিং সেন্টারে গিয়ে কিংবা শিক্ষকের কাছে ব্যাচে পড়ে কাজ হবে না।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী কতটুকু শিখল, তা নিয়মিত ক্লাসে যাচাই করা হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর দুর্বলতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে। এই সহযোগিতার কাজটি করবেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিংবা বিষয়-সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি। শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহযোগিতার কারণে অনেকে মনে করছেন, এতে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা নষ্ট হবে, পড়াশোনার আগ্রহ কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টো ঘটছে। শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার আনন্দময় পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখতে চাওয়ার আগ্রহও বাড়ছে।
তবে মুশকিল হয়েছে শিক্ষকদের নিয়ে। তাঁরা এই শিক্ষাক্রম ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁরা অভিযোগ করছেন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে না। এমনকি সময়মতো শিক্ষক সহায়িকাও তাঁদের হাতে আসছে না। এই শিক্ষাক্রমে পাঠদান প্রক্রিয়াতেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো কেবল শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সীমিত নয়।
প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা, প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ, বিমূর্ত ধারণায়ন ও সক্রিয় পরীক্ষণ—শ্রেণি কার্যক্রমের এই চারটি ধাপ না বুঝে ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। প্রক্রিয়াটি আসলে জটিল কিছু নয়, কিন্তু পরিভাষাগত জটিলতার কারণে শিক্ষকেরা সহজ ব্যাপারটিও জটিল করে ভাবছেন।
অভিভাবকদের অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, ভাত রান্না করা শিখতে স্কুলে যেতে হবে কেন? প্রতিদিন অ্যাসাইনমেন্টের নামে এত টাকা খরচ করাবে কেন? তথ্য অনুসন্ধানের কাজে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোননির্ভরতা বাড়াবে কেন? বাড়ির কাজ হিসেবে কেন দলগত কাজ দেওয়া হবে? এ রকম অনেক প্রশ্ন শিক্ষার্থীকেও দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে—আসলে পড়াশোনা কি ঠিকমতো হচ্ছে? পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, এর উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, শিক্ষকেরা যদি শ্রেণি-কার্যক্রম বুঝে উঠতে না পারেন, তবে হবে না।
নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা মানবিক শাখা নির্বাচনের সুযোগ নেই কেন, এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। আসলে অষ্টম শ্রেণি পাস করা একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে বিষয় নির্বাচনের কাজ সহজ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে অভিভাবকদের ওপর নির্ভর করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল তাকে শাখা নির্বাচনে বাধ্য করে। এখন শিক্ষার্থীকে শাখা নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে একাদশ শ্রেণিতে। আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য সাধারণ ১০টি বিষয় রাখা হয়েছে।
এখানে ঐচ্ছিক বা আবশ্যিক বিষয় বলে কিছু নেই। এতে বিজ্ঞানশিক্ষার ওপর প্রভাব পড়বে কি না, এই প্রশ্ন রেখেছেন কেউ কেউ। সেই বিবেচনা শিক্ষাক্রমের বিষয়-বিশেষজ্ঞদের মাথায় আছে নিশ্চয়। তবে একই সঙ্গে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, সব শিক্ষার্থীর জন্য সাধারণ বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান শেখাতে গেলে বিজ্ঞানের সব শাখার ‘উচ্চতর’ জ্ঞান দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের শিক্ষকদের আর স্কুলগুলোর সক্ষমতার ব্যাপারটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
শিক্ষকেরা অভিযোগ করছেন, এখন আগের চেয়ে তাঁদের কাজের চাপ বেড়েছে। স্কুলে সময় দিতে হচ্ছে বেশি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নেও সময় লাগছে। কিন্তু শ্রেণি-কার্যক্রমের ব্যাপারটি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলে শিক্ষক মূলত শ্রেণিতে কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন।
এই পদ্ধতিতে তাঁর নিজের পড়ানোর কাজটি আগের চেয়ে অনেক কম। আর অ্যাপসের মাধ্যমে মূল্যায়ন করার কাজ শুরু হলে ধারাবাহিক রেকর্ড রাখার কষ্ট কমে যাবে। তাঁদের খেয়াল রাখতে হবে, এখন ক্লাসে পড়িয়ে যাওয়া আর নম্বর প্রদান করা মোটেও উদ্দেশ্য নয়। এখন উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করানো এবং বারবার যাচাই করে তা নিশ্চিত করা।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা মনে করেন, এই শিক্ষাক্রম আনন্দময় পড়ার পরিবেশ তৈরি করবে। মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনকে অগ্রাধিকার দেবে। রেজাল্ট কার্ডে নম্বর বা গ্রেডের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।
তাঁরা আরও মনে করেন, এই শিক্ষাক্রম নতুন শতকের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। দক্ষতা, জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীরা আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। এগুলো নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সবাইকে আস্থায় নিতে না পারলে এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক