উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে বিএনপির কালো পতাকা মিছিল থেকে মঈন খানকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে বিএনপির কালো পতাকা মিছিল থেকে মঈন খানকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ

মতামত

পুলিশ কেন মঈন খানকে বাসায় পৌঁছে দিল?

সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করায় তাঁদের একজন খুব উষ্মা প্রকাশ করলেন। তাঁর ভাষ্য, রাজনীতি তো কোনো পেশা নয়। দেশসেবা। সংসার চালাতে রাজনীতিকদেরও একটি পেশা বেছে নিতে হয়। অনেকের ছোটখাটো ব্যবসাও আছে। তাই বলে অধিকাংশ সংসদ সদস্যকে ‘জনগণের রক্তচোষা’ হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়।

আরেকজন স্বতন্ত্র সদস্য বললেন, তিনি জিতেছেন, এটা নৌকার প্রার্থী কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। নির্বাচনের তিন সপ্তাহ পরও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা হচ্ছে। প্রথম আলোর খবরে পড়লাম, মাদারীপুর-৩ আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ২৫টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দুজন মারা গেছেন, আহত ৭০ জন। এই হলো শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের নমুনা।

স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছে প্রশ্ন ছিল, তাঁরা সংসদে কী ভূমিকা রাখবেন? নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন কি না? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত তাদেরও জানা নেই। দুদিন আগে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি নিঃশর্ত আস্থা প্রকাশ করে এসেছেন। বলেছেন, স্বতন্ত্র হলেও তারা আওয়ামী লীগেই আছেন।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আছে: ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।’ এমনকি সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত কিংবা সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে সেটাও বিপক্ষে ভোট দেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে।

বাংলাদেশের পুলিশ বিরোধী দলের একজন নেতার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে, এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে! এখন যদি জেলখানায় আটক নেতাদেরও একইভাবে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা যায় তাহলে হয়তো অনেক কিছুই নতুনভাবে শুরু করা যাবে!

একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের ওপর ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য নয়।’ কিন্তু তাঁরা দলীয় প্রভাব ও খবরদারির বিষয়টি এড়াবেন কীভাবে?
বর্তমানে সংসদে ২৯৯ জন সংসদ সদস্য আছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬৩ জন। আওয়ামী লীগের সহযোগী ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ নৌকা নিয়ে দুটি আসন পেয়েছে। জাতীয় পার্টির ১১ জন, কল্যাণ পার্টির একজন ও আরও দুই-একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের দলীয়।

ইত্তেফাক শিরোনাম করেছে, ‘অন্য রকম এক সংসদের যাত্রা শুরু আজ।’ নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের ২৮টি নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৫টি বর্জন করে। অংশ নেওয়া ২৮ টির মধ্যে কথিত কয়েকটি ‘কিংস পার্টি’সহ ২৩টিই কোনো আসন পায়নি। সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে মাত্র পাঁচটির।

সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন ৩০ জানুয়ারি বিএনপি কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিল। এ খবর জেনে আওয়ামী লীগও শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ঢাকার কর্মসূচিটি স্থগিত ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দিই, নিত্য যানজটের শহরে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডেকে জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে না দেওয়ার জন্য। তারা অন্য দিন কর্মসূচি পালন করতে পারে। এমনকি পুরো মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলতে পারে, এই সময় বাদ দিয়ে বিরোধী দল কর্মসূচি নিক।

৭ জানুয়ারির আগে আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, বিরোধী দল নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে এবং তা রুখতে তাদেরও মাঠে থাকতে হবে। এখন তো নির্বাচন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করেছে। নতুন সংসদেও তারা বসেছেন। বিএনপি তো সংসদে নেই। সরকারেও নেই। রাজপথই তাদের ভরসা।

বিএনপি চমকে দেওয়ার মতো আরেকটি খবর দিল। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ সহিংস ঘটনার তদন্তে ১১ সদস্যের কমিটি করেছে তারা। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে দলের ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীকে। অন্য সদস্যরা হলেন সুকোমল বড়ুয়া, বিজন কান্তি সরকার, রুহুল কুদ্দুস কাজল, অমলেন্দু দাস, জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু, নিপুণ রায় চৌধুরী, রমেশ দত্ত, এলবার্ট ডি কস্তা, এস এন তরুণ দে ও পার্থ দেব মণ্ডল।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়েছিলেন বলে তথ্য প্রমাণ আছে। ২০২৪ এর নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। কোথাও নৌকা প্রার্থীর লোকজন কোথাও স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজন সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়েছে। যদিও ২০০১ এর তাণ্ডবের সঙ্গে ২০২৪ এর ঘটনা মেলানো যাবে না। তারপরও ‘সংখ্যালঘুদের মিত্র’ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এসেছে এবং বিএনপি তদন্ত কমিটি গঠন করছে। একেই বলে ইতিহাসের রসিকতা।

লেখাটি যখন শেষের দিকে তখনই খবর পাওয়া গেল, বিএনপির কালো পতাকা মিছিল থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানকে পুলিশ আটক করেছে। মঈন খান উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে বিএনপির কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন। গাড়িতে তোলার কয়েক মিনিট আগে তিনি সেখানে পৌঁছান। এ সময় কিছু নেতা-কর্মী রাস্তায় দাঁড়ান। তাঁরা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ৮ থেকে ১০ জন পুলিশ সদস্য দৌড়ে আসে। পুলিশকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক কর্মী দৌড়ে পালিয়ে যান। এ সময় পুলিশ মঈন খানকে গাড়িতে তুলে নেয়। সমাবেশেও পণ্ড হয়ে যায়।

মঈন খানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এডিসি সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, আসলে ওনার নিরাপত্তাঝুঁকি দেখা দিয়েছিল। যে কারণে আমরা তাঁকে একটু সরিয়ে নিয়েছি আরকি।’ কী ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি ছিল, তা জানতে চাইলে এডিসি সালাহউদ্দিন বলেন, মঈন খানের ব্যক্তিগত ও শারীরিক ঝুঁকি ছিল।
পরে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আবুল হাসানের ভাষ্য, মঈন খানকে কেউ আটক করেনি। তাঁকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির প্রথম সারির অনেক নেতা এখন জেলে। কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মঈন খান, রুহুল কবীর রিজভী, নজরুল ইসলাম ও সেলিমা রহমান দলীয় সমাবেশে এসে মনভাঙা কর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশের পুলিশ বিরোধী দলের একজন নেতার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে, এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে! এখন যদি জেলখানায় আটক নেতাদেরও একইভাবে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা যায় তাহলে হয়তো অনেক কিছুই নতুনভাবে শুরু করা যাবে!

সোহরাব হাসান কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক