পুতিনের জগৎ ছোট হয়ে এসেছে

ভ্লাদিমির পুতিন
ভ্লাদিমির পুতিন

উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের একটি গ্রামে নিজের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে ভিরা চেরনুকা নামের সব হারানো নারী প্রতিদিন ভোরে পুতিনকে অভিসম্পাত করে দিন শুরু করেন। তিনি একটা কফিনে আটকানো অবস্থায় যন্ত্রণাকাতর পুতিনকে অনন্তকাল দোজখের সাজা পাওয়া দেখতে চান। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গণহারে শিশু অপহরণের অভিযোগে পুতিনকে গ্রেপ্তার করতে চায়।

বিদ্রোহী ভাগনার গোষ্ঠী পুতিনকে উৎখাত করতে চেয়েছিল এবং মারাত্মকভাবে তাঁকে দুর্বল করে ফেলতে পেরেছে।

রাশিয়ার বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনিও তাঁকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। এখন তাঁকে জেলে প্রতিদিন পুতিনের একটি ভাষণ জোর করে শোনানো হয়। এখন পর্যন্ত এক শ দিনের বেশি হয়ে গেছে, তবু পুতিনের ভাষণের সেই রেকর্ড তাঁকে শোনানো বন্ধ করা হচ্ছে না।

১৮ মাসের কাছাকাছি সময় ধরে ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে পুতিন একটি মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ঘৃণিত হয়েছেন। উপহাসের মুখে পড়েছেন। নিজের সৃষ্ট দুর্দশার বিষয়ে উদাসীন থেকে পুতিন নিজেকে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ও বিপজ্জনক আসামি করে তুলেছেন। পুতিন আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা ও ক্রমবর্ধমান আধ্যাত্মিক অবক্ষয়কে মূর্ত করে তুলেছেন। প্রাচীন উপকথায় উল্লিখিত ভূত-প্রেত ও দেও-দৈত্যের মতো কর্মকাণ্ড তাঁকে ‘বৈশ্বিক ভূতে’ পরিণত করেছে।

এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও সারা বিশ্বে খুব কম লোকই এই ছিমছাম চেহারার সাবেক কেজিবি ঠগকে বিশ্বাস করত। লোকে তাঁকে রাশিয়ার নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করত? অবশ্যই করত। তাঁকে সহ্য করত অথবা ভয় করত? হ্যাঁ, করত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের প্রশংসা করত? না, করত না। এখন পুতিন একেবারেই বন্ধুহীন হয়ে পড়েছেন। তিনি নিজেই এখন রাশিয়ার জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

পুতিনের দানবীয় ভাবমূর্তির কারণে কোনো দেশই তাঁর উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতে পারছে না। এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে আগামী অক্টোবরে তাঁর বেইজিং সফরে যাওয়ার কথা। ধারণা করি, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পুতিনের সঙ্গে ‘সীমাহীন’ অংশীদারির যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি মনে মনে অনুতাপ করে থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই বোঝা হয়ে ওঠা পুতিনের বন্ধুত্বের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। 

চলতি বছরে পুতিনের তিনটি সমস্যাযুক্ত বিদেশ সফর তাঁর একঘরে দশাকে অধিকতর নাটকীয় করে তুলেছে। প্রথমটি হলো আগামী মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর ব্রিকসের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল। 

কিন্তু সেখানকার জনগণের কাছে তিনি অসম্মানিত হতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকে গত মাসে সেই সফরসূচি বাতিল করা হয়েছে। যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসির একটি অংশীদার দেশ; সেহেতু পুতিন সেখানে গেলে তাঁকে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করার বাধ্যবাধকতা আছে। এরপরও ক্রেমলিন চাইছিল, পুতিন সেখানে যাক, কারণ তাঁর কূটনৈতিক রক্ষাকবচ আছে। কিন্তু আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য অবশ্যই থাকতে হবে।

পুতিনের অস্বস্তিকর দ্বিতীয় সফর হতে যাচ্ছে তুরস্কে। আগামী মাসে তাঁর তুরস্কে যাওয়ার কথা। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। আর পুতিন কার্যত ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। এরপরও রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় গ্যাস কেনার চিন্তা থেকে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে গিয়ে পুতিনকে সমর্থন দিচ্ছেন। যেহেতু এরদোয়ান নিজেকে শান্তিবাদী নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চান, সেহেতু পুতিনের তুরস্ক সফর এরদোয়ানের সেই ভাবমূর্তিকে বেকায়দায় ফেলবে। 

পুতিন একসময় বিশ্বের আর দশজন নেতার মতোই বিদেশ সফর করেছেন। কিন্তু সেসব সফর ছিল ২০০৬ সালে লন্ডনে আলেকসান্দর লিতভিনেনকোর হত্যার আগে। পুতিনের দানব চরিত্র ফুটে ওঠার পর থেকে তাঁর জগৎ ছোট হয়ে এসেছে।

পুতিনের দানবীয় ভাবমূর্তির কারণে কোনো দেশই তাঁর উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতে পারছে না। এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে আগামী অক্টোবরে তাঁর বেইজিং সফরে যাওয়ার কথা। ধারণা করি, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পুতিনের সঙ্গে ‘সীমাহীন’ অংশীদারির যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি মনে মনে অনুতাপ করে থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই বোঝা হয়ে ওঠা পুতিনের বন্ধুত্বের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। 

 দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত


সিমোন টিসডালগার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক