হাররি আপ ব্রাদার! লেকচার আমি দেব না। লেকচার আমি দিতে আসি নাই। তবে ভাইয়া, কেবলমাত্র কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে সম্পূর্ণ মাগনায় আমাদের একটি প্রোডাক্ট সম্পর্কে দুই চারখান কথা বলে আপনাদের মাঝ থেকে বিদায় নেব। সম্পূর্ণ দেশীয় কায়দার তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে বানানো আমাদের প্রোডাক্টটির নাম গণতন্ত্র। দিলের কান খাড়া করে হাতের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে দুই মিনিট মজমায় খাড়ায়ে যান।
ভোটের দোহাই, নির্বাচনের দোহাই, একটু খেয়াল করে শুনবেন দাদা—
ডেমোক্রেসি, আই মিন গণতন্ত্র একটি মারাত্মক তন্ত্র। এই তন্ত্রের সাহায্যে কোনো ধরনের যন্ত্র ছাড়াই মন্ত্রের মতো জনগণ নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক ভাবে। সরকারকে ভাবে তাদের কর্মচারী। সরকারও কাগজে কলমে তাই বলে। ফলে, পাবলিক মনে মনে ফল খায়।
খেয়াল করলে দেখবেন দাদাভাই, কারখানা ভেদে সারা দুনিয়ায় মৌলিক গণতন্ত্র, যৌগিক গণতন্ত্র, উদার গণতন্ত্র, কিপটে গণতন্ত্র, নবজাতক গণতন্ত্র, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, টেকসই গণতন্ত্র—এই রকমের হাজার পদের গণতন্ত্র আছে। জিনিস এক; টেস্ট কিন্তু আলাদা। রং আলাদা। ঢং আলাদা। এই জিনিস অনেকটা হাজার জাতের আমের মতো। চিনির মতো মিষ্টি আধা কেজি ওজনের ফজলি আমও আম। আবার তেঁতুলের চাইতে টক বরই সাইজের আমও আম। গণতন্ত্রও তাই। এক দেশের গণতন্ত্রের সঙ্গে আরেক দেশেরটার মিল নাই। ইন্ডিয়ান মাল এক রকম, তো পাকিস্তানেরটা আরেক রকম। আমেরিকারটা এক পদের, তো ব্রিটেনেরটা আরেক পদের। তারপরও এক দেশের গণতন্ত্রের যন্ত্রে গন্ডগোল দেখা দিলে আরেক দেশের গণতন্ত্রের মিস্ত্রি তার নিজের ফর্মুলায় সারাই করার তালে থাকে।
বিরাট আমোদের কথা, বিদেশে বাড়িঘর বানানোর লেবার সাপ্লাই দেওয়ার পাশাপাশি এখন গণতন্ত্র নামক যন্ত্র সারাইয়ের মিস্ত্রি সাপ্লাই দেওয়ারও জায়গায় আমরা চলে গেছি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কথায় বিষয়টি খোলাসা হয়েছে।
অ্যাটেনশন প্লিজ দাদা ভাই!
কয়েক দিন আগে তুরস্কে ভূমিকম্পে হাজারো ভবন ধসে পড়ার পর তাদের হেল্প করার বিষয়ে তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তাদের (তুর্কিদের) নেক্সট ফেজ (পরবর্তী ধাপ) হলো রিকনস্ট্রাকশন। এদের বাড়িঘর বানাবে। তা, আমরা বলেছি, তোমরা যদি বাড়িঘর বানাতে চাও, লেবার যদি দরকার হয়, আমরা লেবার দিতে রাজি আছি।’ তাঁর ‘লেবার দিতে রাজি আছি’ কথাটাকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভুল বুঝে ‘ম্যান পাওয়ারের ছদ্মবেশে সহজলভ্য দাস পাচার’ মনে করেছিলেন। তাতে তাঁরা খুব মন খারাপ করেছেন। তাঁদের অনেকে বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালি ‘লেবার’ সাপ্লাই দেওয়ার কথা বললেন কেন? আমরা ইঞ্জিনিয়ার কনসালট্যান্ট সাপ্লাই দিতে পারি না!
ভারি আনন্দের কথা, প্রবাসীদের সেই মনঃকষ্টের আগুনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু পানি ঢেলে দেননি; ঢাকায় সফর করতে আসা যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যান-মারি ট্রিভেলিয়ানের সঙ্গে গত রোববার বৈঠক করার পর তিনি সাংবাদিকদের যা বলেছেন, তাতে বেজার হওয়া প্রবাসীরা নির্ঘাত খুশিতে বাকবাকুম করে উঠেছেন। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের যদি কোনো দুর্বলতা থাকে তাহলে তাঁরা বাংলাদেশের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে পারেন। অর্থাৎ আমরা শুধু বিদেশে ঘরবাড়ি বানানোর লেবারই দিই না; গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ঠিকঠাক করে দেওয়ার কনসালট্যান্টও দিতে পারি। আর বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেও বিদেশিদের তিনি মানা করে দিয়েছেন।
সাক্ষাতের বিষয়বস্তু নিয়ে বলতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ওনারা জিজ্ঞেস করেননি, আমিই বলেছি আগামী নির্বাচনের কথা। আমরা একটা স্বচ্ছ, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চাই। সে জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত, আমরা সেগুলো তৈরি করেছি।’
আব্দুল মোমেন আরও বলেছেন, ‘আমাদের জনগণ অত্যন্ত সেয়ানা। তারা অত্যন্ত পরিপক্ব। ভোটের সময় তারা কখনো ভুল ভোট দেয় না। সুতরাং, এসব নিয়ে আপনাদের (যুক্তরাজ্যের) দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।...আমাদের রক্তে হচ্ছে গণতন্ত্র, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবাধিকার। এসব বিষয়ে অন্য কারও কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। আপনাদের দুর্বলতা থাকলে আমাদের থেকে নিতে পারেন।’
অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পাঠ নিয়েছে তা খুবই উন্নত ও সবল। এ বিষয়ে বিলাতি সাহেবদের দুর্বলতা থাকলে সবল হিসেবে তাঁদের টেনে তোলাটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু মাথামোটা ওই প্রেসিডেন্টের জানা ছিল না বাংলাদেশের ‘অত্যন্ত সেয়ানা’ জনগণ গণতন্ত্র বলতে বুঝবে ‘Government off the people, buy the people, far the people’ (জনগণকে বাদ দিয়ে, জনগণকে কিনে, জনগণকে দূরে ঠেলে দেওয়া সরকার)। সেই বুঝকে আমরা যদ্দুর পারছি কাজেও খাটাচ্ছি।
আব্রাহাম লিংকন নামের এক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তাঁর গণতন্ত্র বিষয়ক ভাসা ভাসা জ্ঞান থেকে বলেছিলেন, ‘Government of the people, by the people, for the people (জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা গঠিত জনগণের সরকার) ’। কিন্তু মাথামোটা ওই প্রেসিডেন্টের জানা ছিল না বাংলাদেশের ‘অত্যন্ত সেয়ানা’ জনগণ গণতন্ত্র বলতে বুঝবে ‘Government off the people, buy the people, far the people’ (জনগণকে বাদ দিয়ে, জনগণকে কিনে, জনগণকে দূরে ঠেলে দেওয়া সরকার)। সেই বুঝকে আমরা যদ্দুর পারছি কাজেও খাটাচ্ছি।
শুধুমাত্র কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে সেই জ্ঞানকে আমরা বিনা এলসিতে যুক্তরাজ্যে পর্যন্ত এক্সপোর্ট করার প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছি—ভাবতেই ভালো লাগছে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com