লোহিত সাগরে হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নেওয়া মার্কিন রণতরি
লোহিত সাগরে হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নেওয়া মার্কিন রণতরি

মতামত

লোহিত সাগরকে হুতিমুক্ত করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?

লোহিত সাগরে গত ৩০ ডিসেম্বর ডেনিশ কোম্পানি মারেস্ক লাইন-এর মালিকানাধীন একটি জাহাজে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে এবং নৌযান থেকে গোলা ছুড়ে হামলা চালায়। কনটেইনারবাহী বিশাল জাহাজটিকে রক্ষা করতে মার্কিন নৌবাহিনী এগিয়ে আসে। তারা আক্রমণকারী চারটি ছোট জাহাজের মধ্যে তিনটিকেই ধরাশায়ী করতে হেলিকপ্টার থেকে হামলা চালাতে থাকে। পরে কোনোমতে, জাহাজটি রক্ষা করা সম্ভব হয়।

ওই ঘটনার পর বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিপিং কোম্পানি মারেস্ক লোহিত সাগর দিয়ে পণ্য পরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। মারেস্কের সঙ্গে পশ্চিমা বড় বড় শিপিং প্রতিষ্ঠান ওই অঞ্চল দিয়ে পণ্য পরিবহন করা বাদ দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ পথ ঘুরে পণ্য পরিবহন শুরু করে।

গত অক্টোবরে হুতিরা ঘোষণা দিয়েছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা জাহাজগুলোতে তারা হামলা চালাবে। এর পর থেকে তারা প্রায় নিয়মিতভাবে ইসরায়েলগামী বা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ত থাকা জাহাজে হামলা চালিয়ে আসছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় গত ১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ান শীর্ষক একটি টাস্কফোর্সের ঘোষণা দেয়। এই টাস্কফোর্স হুতিদের হামলা মোকাবিলায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি হুতি গোষ্ঠীকে যারা তহবিল সরবরাহ করে, বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা যেসব গোষ্ঠী হুতিদের তহবিল দিয়ে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু লোহিত সাগরের একেবারে সংকুচিত জলসীমা অঞ্চল এবং সুয়েজ খালের ‘বটলনেক’ এলাকায় এখনো বৈশ্বিক শিপিংয়ের জন্য নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গত ডিসেম্বরে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল ২০ শতাংশ কমে গেছে। আর সুয়েজ খাল দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজের চলাচল গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

লোহিত সাগর দিয়ে না গিয়ে ঘুরপথে জাহাজ চলাচলের প্রভাব বৈশ্বিকভাবে অনুভূত হচ্ছে। মহাসাগরে কার্গো পরিবহনের খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিপিং–সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান ফ্রেইটস এক প্রতিবেদনে বলেছে, জানুয়ারির গোড়াতেই এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপে ৪০ ফুটের একটি কনটেইনার পাঠানোর খরচ ৪ হাজার ডলারে পৌঁছে গেছে। জানুয়ারির শুরু থেকে মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ ফুটের একটি শিপিং কনটেইনার ভারত থেকে ইউরোপ ও মার্কিন পূর্ব উপকূলে পরিবহন করার ব্যয় ৬০০ ডলার থেকে দেড় হাজার ডলারে উঠে গেছে। এর সঙ্গে সারচার্জ বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।

এর মধ্যেও যারা লোহিত সাগরে চলাচল করতে চায়, তাদের জন্য বিমা খরচ হিসেবে প্রতি যাত্রায় সংশ্লিষ্ট জাহাজের মূল্যের ০.২ শতাংশ থেকে তিন গুণ বেড়ে ০.৭ শতাংশ পর্যন্ত বিমা প্রিমিয়াম দিতে হচ্ছে। যদিও ভোক্তারা এখনো মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাটা অনুভব করতে পারছেন না; তবে আগামী কয়েক সপ্তাহে মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি টের পাওয়া যাবে।

ইয়েমেনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে গিয়ে হুতিরা মিসাইল, রাডার, হেলিকপ্টার, ছোট নৌকা এবং সস্তা ড্রোনের সমন্বয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে থাকে। হুতিদের ব্যবহার্য ২ হাজার ডলার দামের ড্রোন ধ্বংস করতে ২০ লাখ ডলার দামের মিসাইলের ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পোষায় না।

২০২১ সালে সুয়েজ খালে কনটেইনারবাহী জাহাজ এভার গিভেন প্রায় ছয় দিন আটকা পড়ে থাকার পর বৈশ্বিক বাজারে তার যে প্রভাব পড়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লেগে গিয়েছিল। সেই একই অবস্থা ঘটতে চলেছে। নিজের প্রভাব বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র অতীতে সফলভাবে বৈশ্বিক জাহাজ ব্যবস্থার হুমকি সামাল দিয়ে এসেছে।

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে কয়েক ডজন দেশের সেনা নিয়ে গঠিত কম্বাইন্ড মেরিটাইম ফোর্সেস মধ্যপ্রাচ্যকে নজরদারির আওতায় রাখছে। ২০০৯ সালে গঠিত কম্বাইন্ড টাস্কফোর্স ১৫১ (সিটিএফ-১৫১) সোমালিয়ার জলদস্যুদের মতো হুমকিকে সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। তবে এবার হুতিরা যে ধরনের আক্রমণ কৌশল বেছে নিয়েছে, তাকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র শতভাগ সক্ষম কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

ইয়েমেনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে গিয়ে হুতিরা মিসাইল, রাডার, হেলিকপ্টার, ছোট নৌকা এবং সস্তা ড্রোনের সমন্বয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে থাকে। হুতিদের ব্যবহার্য ২ হাজার ডলার দামের ড্রোন ধ্বংস করতে ২০ লাখ ডলার দামের মিসাইলের ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পোষায় না।

ইরানের কাছ থেকে আনুষঙ্গিক সহায়তাপুষ্ট হুতিরা যেহেতু ফিলিস্তিনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, সেহেতু ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট জাহাজে তাদের হামলার বিষয়ে আঞ্চলিক দেশগুলো প্রতিক্রিয়া দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে হুতিরা এসব দেশের কাছ থেকে খুব কম বাধা পেয়ে থাকে।

আট বছর ধরে সৌদি আরব ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও ২০২২ সালে সৌদি সরকার হুতিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করে। এই অঞ্চলে বাহরাইনের মতো যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র তারাও যুক্তরাষ্ট্রের এবারের গঠিত অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ানে যোগ দেয়নি। কারণ, এই সংঘে যুক্ত হলে আরব দেশগুলো তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ সমর্থনের অভিযোগ আনতে পারে। এমনকি সুয়েজ খাল সচল না থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে যে দেশটি, সেই মিসরও যুক্তরাষ্ট্রের এই হুতিবিরোধী জোটে যোগ দিতে রাজি হয়নি।

এসব কারণে হুতিদের এই হুমকি এবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সামাল দেওয়া খুব সহজ হবে না।

  • জন পি রুহেল ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী একজন অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত