সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন বিষয়ে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীদের বিভিন্ন আলোচনায় বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে বিষয়টির প্রায়োগিক জ্ঞান অত্যন্ত কম। মূলত ফেডারেল বা প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা না থাকলে, অর্থাৎ স্বাধীন স্থানীয় সরকার ছাড়া আনুপাতিক বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) ব্যবস্থা কাজ করে না। এ আলোচনা শতভাগ অনুপস্থিত। ইউরোপের প্রতিটি দেশে যারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন বাস্তবায়ন করেছে, তাদের স্বাধীন, সক্ষম ও শক্তিশালী স্থানীয় ও নগর সরকার—উভয়ই আছে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) হচ্ছে ‘সেন্ট্রাল রিপ্রেজেন্টেশন’ বা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিত্ব। আপনাকে লোকাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তৈরি করা লাগবে নাগরিকের স্থানীয় চাহিদা মেটাতে। এটা ইউনিয়ন ও উপজেলা শক্তিশালী করে হবে না। বরং এমন স্থানীয় সরকার লাগবে, যা তার বাজেট নিজে তৈরি করতে পারবে; যাদের কর বা রাজস্বকাঠামো আছে; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচারসহ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো রাষ্ট্রের সব ধরনের নাগরিক সেবা নিজে স্বাধীনভাবে দেবে এবং সেবা ব্যবস্থাপনার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। কেন্দ্র এখানে শুধু কোয়ালিটি মনিটরিং করবে এবং রেগুলেটরি গাইডলাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কাঠামো ফেসিলেটেট করবে।
বাংলাদেশে আসলে কোনো স্থানীয় সরকার নেই। দেশের সংসদ নির্বাচনী আসনের ভোটাররা কনস্টিটুয়েন্সির এমপিকে রাষ্ট্রের আইন করার জন্য ভোট দেন না, মূলত ভোট দেন তাঁকে সার্ভ করার জন্য। বোঝাপড়াটা এখানেই চাই।
স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন জীবন, অর্থনীতি ও অবকাঠামোর মৌলিক সেবাদান ও সামাজিক নিরাপত্তার সমস্যা মোকাবিলায় সক্ষম স্থানীয় সরকার গড়তে পারলেই তখন কেন্দ্রের জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন প্রাসঙ্গিক হবে, এর আগে নয়। কেননা, আনুপাতিক নির্বাচনের জেতা সংসদ সদস্যের ভিন্ন এলাকার মানুষকে সার্ভ করার দায় তৈরি হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর সে জ্ঞান, লেজিটিম্যাসি ও এখতিয়ারও থাকে না। কারণ, তিনি স্থানীয় মানুষের প্রতিনিধি নন।
সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। তবে আনুপাতিক পদ্ধতির দুটি মডেল আছে। আধুনিক মডেলে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করে ব্যালটভুক্ত করা হয়। পুরোনো ও অপরিপক্ব মডেলে দলকে ম্যান্ডেট দেওয়া হয়। আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো চাইছে শুধু দলের নাম ও প্রতীকের ভিত্তিতে ভোট এবং প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে ভাগে পড়া আসনগুলোয় দলীয় প্রধান বা দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচন।
পিআর নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও আমাদের অজ্ঞানতা কিংবা শঠতা আছে। তারা বলছে, এ ব্যবস্থায় ভোটার ব্যক্তিপ্রার্থীকে নয়, বরং দলকে ভোট দেন। এটা ইমম্যাচিউর পিআর ধারণা। আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার পরিপক্ব হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। নেদারল্যান্ডসের ভোটার শুধু দলকে নয়, বরং সারা দেশের সব দলের সব প্রার্থীর মধ্যে দলের প্যানেলের (দলের নামের নিচে প্রার্থীদের নাম থাকে ব্যালটে) শুধু একজন প্রার্থীকে ভোট দেন। একটি দলের সব প্রার্থীর প্রাপ্ত মোট জাতীয় ভোটের শতাংশের বিপরীতে ওই দলের সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীরা মনোনীত হন। এর মাধ্যমে দলের বা দলীয় প্রধানের স্বৈরতন্ত্র প্রতিহত করা হয়। দলকে ভোট দিলে দল বা তার প্রধান একক সিদ্ধান্তে সব সংসদ সদস্য নির্বাচন করে বিপর্যয় তৈরির বহু উদাহরণ বিশ্বে রয়েছে। অপরিপক্ব সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার দেশগুলো তাই পিআর নিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপদে আছে।
পিআর-ব্যবস্থায় স্থানীয় কোনো আসন থাকে না। এক ব্যক্তি সারা দেশের একজনকে মাত্র ভোট দেন। দলের ভেতর যাঁরা সর্বোচ্চ ভোট পান, তাঁরা দলের প্রাপ্ত শতাংশের মধ্যে সিলেক্টেড হন।
এ ধরনের ব্যবস্থায় আপনি নিম্নকক্ষে বাংলাদেশের সংসদের মতো ৩০০ আসন রাখতে পারবেন না। এতে ব্যালট পেপারে আসনসংখ্যার আনুমানিক দ্বিগুণ প্রার্থীর তালিকা থাকবে, যা থেকে সারা দেশের সব ভোটার মাত্র একজনকে ভোট দিতে পারবেন। ভোটার একাধিক ব্যক্তিকে ভোট দিলে তা বাতিল হবে। এমন ব্যালট ছোটখাটো পুস্তিকার রূপ নেয়। টিভিতে যখন ইউরোপের ভোট দেখানো হয়, দেখবেন, পুস্তিকার মতো মোটাসোটা ব্যালট পেপার ফেলা বাক্সে হয়। বাংলাদেশে এ রকম ব্যালট প্রবর্তন করা অসম্ভব। প্রথমত লজিস্টিক ঝামেলা। দ্বিতীয়ত, এটা ভোটারদের ব্যবহারবান্ধব এবং তৃতীয়ত, সচেতনতা, পিআর লিটারেসি না থাকা। অর্থাৎ আমাদের পিআর আনতে গেলে নিম্নকক্ষের আসন কমাতে হবে প্রায় অর্ধেক।
একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ধরুন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ৪৫ শতাংশ ভোট পাবে। কিন্তু দলটি ৬০ শতাংশ আসনে প্রার্থী দেবে আওয়ামী লীগ নেই বলে ফ্লোটিং ভোট পাওয়ার অনুমানের ভিত্তিতে। জামায়াতও একই কাজ করবে। এতে ব্যালটে প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে জনপরিসরে ও মিডিয়ায় যা ছড়ানো হচ্ছে, তা আনুপাতিক নির্বাচনের একটা সেকেলে ধারণা এবং এটা স্বৈরতান্ত্রিক বলে উন্নত দেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙার নাম করে আমরা নতুন এবং আরও ব্রুটাল স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি চাই না। বর্তমান ব্যবস্থায় এলাকাভিত্তিক প্রার্থী আছে বলে দলগুলোর এলাকাভিত্তিক বরাদ্দ এবং ব্যক্তি মনোনয়নের দায় আছে। অপরিপক্ব আনুপাতিক নির্বাচনে এ দায় উঠে গেলে বিপদ বাড়বে।
অনেক সময় আনুপাতিক নির্বাচনে একক দলের আসনসংখ্যা নিরঙ্কুশ হয় না বলে সরকারব্যবস্থা স্থিতিশীল হয় না। অধিকাংশ দেশেই পিআরে কোয়ালিশনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয় এবং যখন-তখন সরকার পতনের আশঙ্কায় জর্জরিত দুর্বল সরকার তৈরি হয়। আস্থা ভোটে হেরে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সরকারকে কেয়ারটেকার রোল প্লে করা লাগে, যাতে রুটিনওয়ার্ক করা যায় মাত্র। তারা বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে এসব দেশে শক্তিশালী স্থানীয় ও নগর সরকার থাকে বলে নাগরিক সেবায় সরকার না থাকার বিষয়গুলো অনুভূত হয় না। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার না থাকায় এখানে পিআর বিপর্যয় তৈরি করবে। স্থানীয় সরকারহীন, ভেটিং ও ভোটিং রাইটহীন, দলীয় ম্যান্ডেটের পিআর খারাপের চেয়েও বেশি খারাপ ব্যবস্থা।
আধুনিক পিআর–ব্যবস্থায় প্রার্থী দলের বিরুদ্ধে সংসদীয় বিলে ভোট দিতে পারেন, এখানে হর্স ট্রেডিং বৈধ। হর্স ট্রেডিং দলের ভেতরের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে, যাতে দল সংসদে বিল তোলার আগেই অভ্যন্তরীণ ফোরামে তা ভেটিং করে। আদর্শিক ভিন্নতায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মতৈক্য কিংবা জাতিগত প্রতিনিধিত্ব না থাকলে বঞ্চিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলো ভেঙে যায়। বাংলাদেশে বাম, ইসলামি দল ও হিন্দু প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এসব সমস্যায় পড়বে।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যদি কোনো সংখ্যালঘুকে ৩০০ আসনে মনোনয়ন না দেয়, একজন সংখ্যালঘুর পক্ষে সংসদে এমপি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যায়। আনুপাতিক নির্বাচনে এই অস্বস্তি থেকে সংখ্যালঘুরা বেরোনোর পথ খুঁজবে এবং সেটা উচিতও। রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগোষ্ঠী বা পলিটি হতে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নিজস্ব ‘সংখ্যালঘু এজেন্সি’ তৈরি করতে গেলে আওয়ামী লীগের রিজার্ভ সংখ্যালঘু ভোট নিঃশেষ হবে। বর্তমানে সংখ্যালঘুদের রাজনীতি ও নিরাপত্তার এজেন্সি আওয়ামী লীগের কাছে জমা আছে। পিআর সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক এজেন্সির মুক্তি ঘটাতে পারে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরে জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতাকে হত্যার বিচার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয় আছে। যেহেতু জনপরিসরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুপস্থিত, আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এত দিন বিরোধিতা করে এলেও এখন আনুপাতিক নির্বাচন চাইছেন মূলত দলটিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চিন্তা থেকে। বাস্তবেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ। তবে পিআর আলোচনা এগিয়ে গেলে রাজনৈতিক ও সরকারি সিদ্ধান্তে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিও প্রবল হবে।
একদল ডান ও বাম মনে করছেন, তাঁরা পিআর–ব্যবস্থায় ন্যূনতম আসন পাবেন, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে (ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে) একটা আসন পাওয়াও তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আনুপাতিক নির্বাচনে সংসদে আসন পেতে ন্যূনতম একটি ভোট পাওয়া লাগে, বিভিন্ন দেশে এটা ৩ শতাংশ। ইউরোপের কিছু দেশে এই নীতির ফলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান লক্ষণীয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অধিকাংশ বাম দল ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অপরাপর ইসলামি দলের পক্ষে আনুপাতিক হিসাবেও সংসদে আসন পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, ঐতিহাসিকভাবে তারা কখনো জাতীয় পর্যায়ে ১ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি।
উপরন্তু, গণ-অভ্যুত্থানের পরে জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতাকে হত্যার বিচার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয় আছে। যেহেতু জনপরিসরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুপস্থিত, আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এত দিন বিরোধিতা করে এলেও এখন আনুপাতিক নির্বাচন চাইছেন মূলত দলটিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চিন্তা থেকে। বাস্তবেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ। তবে পিআর আলোচনা এগিয়ে গেলে রাজনৈতিক ও সরকারি সিদ্ধান্তে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিও প্রবল হবে।
বস্তুত জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ (সিনেট), নিম্নকক্ষ (অ্যাসেমব্লি হাউস) এবং স্বাধীন স্থানীয় সরকার গড়া গেলেই পরে সরকারব্যবস্থার অন্তত একটি বা দুটি স্তরকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনে নেওয়া যায়। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও নগর করা গেলে পরে জাতীয় সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষের গঠনগত আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে। সেখানে আনুপাতিক নির্বাচন, বিশেষজ্ঞ বা পেশাজীবী প্রতিনিধিত্ব, নারী আসন, সংখ্যালঘু ধর্ম–জাতি–উপজাতি–প্রতিবন্ধী ইত্যাদি এবং আঞ্চলিক মেরিটোক্রেটিক প্রতিনিধি নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া প্রাসঙ্গিক হবে।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য চলমান সংস্কার আলোচনার কেন্দ্রে নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সংসদে কারা যাবেন, সেটা পুরোপুরি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল করা যাবে না। তাই পিআর নির্বাচনপদ্ধতি প্রয়োগের সঠিক শাসনতান্ত্রিক মডেল এবং আধুনিক পিআর–ব্যবস্থার গুণগত বিবেচনা দরকার। এ জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং সেমতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সাজাতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়া, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গড়া, যা একটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হবে—চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরে কাজটা না করলে কবে করবে বাংলাদেশ?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক faiz.taiyeb@gmail.com