মুখভর্তি আর দশজনের চেয়ে আলাদা ধরনের দাড়ি এবং চটকদার ভাষণ দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে তোলার অসামান্য ক্ষমতা আলেকসান্দর দুগিনের জন্য মানুষের মন জয় করা সহজ করে তুলেছে। কেউ কেউ এই চরম ডানপন্থী দার্শনিককে ‘পুতিনের মগজ’ কিংবা ‘রাসপুটিন’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
দুগিনকে ক্রেমলিনে বিশেষভাবে গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়—এমন ধারণা অনেক ভাষ্যকার অবশ্য অস্বীকার করে থাকেন। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলে থাকেন, দুগিনকে যে ক্রেমলিন প্রচলিত ধারণার মতো করে গুরুত্ব দেয় না, তার বড় প্রমাণ হলো ২০১৪ সালে তিনি মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতার চাকরিটি হারিয়েছিলেন।
তবু এখনো অনেকে স্পষ্টতই দুগিনকে সত্যি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। গত সপ্তাহান্তে তাঁর মেয়ে দারিয়া দুগিনা মস্কোর বাইরে গাড়িবোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। অনুমান করা হচ্ছে, হত্যাকারীদের আসল লক্ষ্য ছিলেন দুগিন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে দুগিন বেঁচে গেছেন। পুতিন ও দুগিনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যা–ই থাকুক না কেন, পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ করার সিদ্ধান্তটি সেই আইডিয়াগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে, যা দুগিন ১৯৯০ দশকের শুরু থেকে বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিয়ে আসছেন।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত দুগিনের বই ফাউন্ডেশনস অব জিওপলিটিকস রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর জেনারেল স্টাফ একাডেমিতে পড়ানোর জন্য নির্ধারিত হয়েছিল। ওই বইয়ে দুগিন যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের কোনো ভূরাজনৈতিক অর্থ নেই।’ ২০১৮ সালে সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পুতিনের ওপর তাঁর প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে দুগিন নীরব ছিলেন। তবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তিনি ‘পুতিনের অনেক আগে’ ১৯৯০–এর দশকে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন।
চীনে দুগিনের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বলা হয়ে থাকে, তিনি পুতিনের সঙ্গে তাঁর অনুমিত নৈকট্যকে পুঁজি করেছেন এবং তাঁর ভাষাগত দক্ষতা (তিনি অনর্গল ইংরেজি ও ফরাসি বলতে পারেন) তাঁকে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা তৈরি করতে সক্ষম করেছে।
চীন, ইরান ও তুরস্কে যাঁরা আমেরিকার আধিপত্য ধ্বংস করতে চাইছেন, দুগিন যেন তাঁদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ‘বিশ্বায়নবাদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা অতি ডানপন্থী আন্দোলনকর্মীদের মিত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফুদানে সিরিজ বক্তৃতায় দুগিন যুক্তি দিয়েছিলেন, মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটাতে রাশিয়া ও চীনকে অবশ্যই যৌথভাবে একটি ‘বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা’ তৈরি করতে হবে।
গত এপ্রিলে একটি বৈঠকে রাশিয়ান ও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দুগিনের এ আইডিয়া গ্রহণ করেছিলেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই–কে আশ্বাস দিয়েছিলেন, দুটি দেশ ‘একসঙ্গে হবে...একটি বহু মেরুকেন্দ্রিক, ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে।’ দুগিনের বিশ্বদর্শনমতে, রাশিয়াকে কেন্দ্র করে দাঁড়িয়ে থাকা ইউরেশীয় স্থলভাগের মহাদেশীয় দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামুদ্রিক শক্তিনির্ভর বিশ্বের বিরোধিতা করে।
ইউক্রেনের সরকার দুগিনের মেয়ের গাড়িতে বোমা হামলার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু তাতে মস্কোর অনেকের মন নরম হবে না। দুগিনের মতো চরম জাতীয়তাবাদী অনেকেই আগে থেকে রাশিয়াকে আরও নির্মম আঘাত হানার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
দুগিন ‘ইউরোপ, রাশিয়া ও এশিয়ার মুখোমুখি হওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইংল্যান্ডের নেতৃত্বাধীন শত্রু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখার জন্য’ নাৎসি দার্শনিক কার্ল স্মিটের প্রশংসা করেছেন। দুগিনের এই পশ্চিমাবিরোধী এবং অনুদারপন্থী ধারণাগুলো ইরানেও অনেক আগ্রহী শ্রোতা পেয়েছে। বিভিন্ন পশ্চিমাবিরোধী শাসনব্যবস্থার কট্টর ঘরানার নেতাদের মধ্যে দুগিন বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
২০১৫ সালে দুগিন ইরানে সফরকালে তাঁকে স্বাগত জানানো ইরানি কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ইরান হলো ‘আধুনিকতার (এটি দৃশ্যত ভালো বিষয় হলেও, এটিকে পশ্চিমাদের হাতিয়ার বলে পশ্চিমাবিরোধীরা মনে করে থাকেন) বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল ভিত্তি।’ তিনি নিয়মিত তুরস্ক সফর করেছেন, কখনো কখনো সে দেশের ক্ষমতাসীন একেপির অতিথি হিসেবে।
দুগিন ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক রুশ ব্যাংকার কনস্তান্তিন মালোফিভ অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি, ইতালির লিগ এবং ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালির মতো কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। রাশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপে আয়োজিত সম্মেলন, বক্তৃতানুষ্ঠান এবং সভায় এসব দলের প্রতিনিধিদের এনে তাঁদের সঙ্গে দুগিন সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে দুগিনের আদর্শিক অনুগামীরা স্বভাবতই কট্টর ডানপন্থী। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রথম দিকে দুগিন ষড়যন্ত্রতত্ত্ববিদ অ্যালেক্স জোনসকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে দুগিন বলেছিলেন, ‘মিস্টার ট্রাম্প, যাঁকে আমি আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে সমর্থন করি’।
তিনি জোনসকে বলেছিলেন, ট্রাম্পপন্থী এবং পুতিনপন্থী শক্তিকে এক হয়ে ‘আমাদের সাধারণ শত্রু, বিশ্বায়নবাদীদের’ বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমেরিকান কট্টর ডানপন্থী নেতা রিচার্ড স্পেন্সার, যিনি ট্রাম্পের বিজয়ের পরে ‘ট্রাম্প দীর্ঘজীবী হোন!’ বলে উল্লাস করেছিলেন এবং ট্রাম্পকে সশস্ত্র স্যালুট দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন, সেই স্পেন্সারও রাশিয়ান জাতীয়তাবাদী দুগিনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্পেনসারের স্ত্রী দুগিনের লেখা বইগুলো রুশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
সম্প্রতি চীনা ও পাকিস্তানি শিক্ষাবিদদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনায় দুগিন দর্শক–শ্রোতাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে রাশিয়া প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে, কিন্তু কিছুতেই ইউক্রেনের কাছে হার স্বীকার করবে না। এখন যে প্রশ্নটি উঠে আসছে, সেটি হলো গত সপ্তাহান্তে গাড়িবোমা হামলা দুগিন–তনয়া নিহত হওয়ার ঘটনা ক্রেমলিনকে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও আক্রমণাত্মক নীতির দিকে নিয়ে যাবে কি না।
রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি হামলায় কারা জড়িত, তা জানতে পেরেছে বলে দাবি করেছে। তারা ইউক্রেনকে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করে দাবি করেছে, অভিযুক্ত খুনি ইতিমধ্যে রাশিয়া থেকে পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এস্তোনিয়ায় ঢুকেছে। এ অভিযোগগুলো কিয়েভে রাশিয়ার হামলা জোরদার করার ন্যায্যতা প্রমাণে ব্যবহার করা হতে পারে।
এর ধারাবাহিকতায় রাশিয়া কিয়েভের প্রধান প্রধান সরকারি ভবন এবং কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। যদি ক্রেমলিন এস্তোনিয়ার মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং হুমকি দিয়ে অভিযুক্ত সন্দেহভাজনকে প্রত্যর্পণের দাবি তোলে, তাহলে সেটি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। কারণ, এটি রাশিয়াকে একটি ন্যাটো রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেবে।
ইউক্রেনের সরকার দুগিনের মেয়ের গাড়িতে বোমা হামলার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু তাতে মস্কোর অনেকের মন নরম হবে না। দুগিনের মতো চরম জাতীয়তাবাদী অনেকেই আগে থেকে রাশিয়াকে আরও নির্মম আঘাত হানার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
তাঁরা এবার আরও সরব হবেন। দুগিন বক্তৃতার মিলনায়তন কিংবা টেলিভিশনের স্টুডিওতে বসে, অর্থাৎ প্রকৃত লড়াইয়ের ময়দান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে এত দিন হিংসাত্মক এবং উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু গত সপ্তাহান্তে প্রকৃত লড়াইয়ে তিনি জড়িয়েছেন। সেই লড়াইয়ে নিজের মেয়েকে হারিয়েছেন। এটি তাঁকে আরও হিংস্র করবে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জিডিওন র্যাকমান ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এর বৈদেশিক বিষয়ের প্রধান কলামিস্ট