বাংলাদেশে কোনো কার্যকর বিনিয়োগ নীতিমালা নেই। বিনিয়োগ আকর্ষণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিনিয়োগের চেয়ে সরকারগুলোকে ঋণের পেছনেই বেশি ছুটতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ কেন বিনিয়োগ আকর্ষণে বারবার পিছিয়ে পড়ছে, তা নিয়ে লিখেছেন মামুন রশীদ
২০০৪ সালে তখন টান টান উত্তেজনা। ভারত-চীন সীমান্তে অস্থিরতা। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ প্রদানের অভিযোগ চীনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যেই চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর মধ্যে আলোচনা চলছে।
চীনা পক্ষ থেকে প্রধান চাওয়া ছিল চীনের বৃহৎ কোম্পানিগুলোর জন্য ভারতের বর্ধিষ্ণু বাজার খুলে দেওয়া। সেই থেকে বিভিন্ন বিরোধ আর বৈশ্বিক উত্তেজনা নিয়েও ভারতের বাজারে চীনা কোম্পানির ব্যবসা বাড়ছে। ভারতের জনপ্রিয় নায়িকারা চীনা পণ্যের মডেল হয়ে মাঝেমধ্যে জনরোষের মুখেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বেশ কিছুদিন আগে ভারতের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা দ্য হিন্দুর হেডলাইন ছিল—যখন গণচীনে মার্কিন কোম্পানি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছিল, তখন কেন কোনো ভারতীয় কোম্পানি তা কিনে নিল না।
বাংলাদেশ না পারছে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে, না পারছে বাইরে বিনিয়োগ করতে। এই অভিযোগ বহুদিনের। এখন শোনা যাচ্ছে যে বিশ্বের প্রায় এক হাজার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী বা গ্রুপকে নাকি বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রণোদিত করা হবে। এমনটা যেকোনো বিনিয়োগপ্রত্যাশী দরিদ্র দেশের জন্য সুসংবাদ, তাতে সন্দেহ নেই।
স্থানীয় পুঁজির দারিদ্র্য কমাতে কিংবা প্রযুক্তি হস্তান্তরের নিমিত্তে বিশ্বের সব দেশের সরকারই বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। বিনিয়োগ পাওয়ার খাতিরে নানা সুবিধাও দেয়। আমরা জানি কোভিড অতিমারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাজার এখন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বিনিয়োগ থেকে আসে কর্মসংস্থান, বাড়ে রাজস্ব, কমে দারিদ্র্য।
● স্থানীয় পুঁজির দারিদ্র্য কমাতে কিংবা প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য বিশ্বের সব দেশের সরকারই বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে।
● বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের নীতিগত ও পরিচালনগত দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে অনেক বিকল্প থাকায় তারা পছন্দমতো দেশ নির্বাচন করতে পারে।
● বিদ্যমান ব্যবসার পাশাপাশি আমাদের নতুন নতুন বাজার ধরতে হবে। শুধু বস্ত্র খাতে ইউরোপের ওপর ভর করে থাকলে চলবে না।
● নতুন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যারা ইতিমধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে, তাদের দেখভাল করা।
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হলো এক দেশ থেকে আরেক দেশে সরাসরি বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা। বিদেশি কোম্পানিগুলো মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি নিয়ে আসে। বিদ্যমান ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা আবার বিনিয়োগও করে। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানি ঋণ (ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন) নিয়ে বা শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করে।
এফডিআইবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে গ্রহণ করতে হয় নানা ধরনের নীতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে কোনো কার্যকর বিনিয়োগ নীতিমালা নেই। বিনিয়োগ আকর্ষণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিনিয়োগের চেয়ে সরকারগুলোকে ঋণের পেছনেই বেশি ছুটতে দেখা গেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। এফডিআই বাড়াতে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ৩৯টি হাইটেক পার্ক তৈরি করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা। তবু বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আগের তুলনায় নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। একই সময়ে নতুন বিদেশি মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর ইক্যুইটি ক্যাপিটাল স্টক কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
আঙ্কটাডের ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে ২০১৭-২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। ‘রূপকল্প ২০৪১’ অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে হলে বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ এফডিআই পেতে হবে।
বিশ্বের ৩৫তম বড় অর্থনীতির এই দেশ কেন আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে না? কেন দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও জিডিপির হিসাবে এফডিআইয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ? এ অঞ্চলে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশও জিডিপির শতাংশ হিসাবে এফডিআইয়ে এগিয়ে।
২০২২ সালে মালদ্বীপ এফডিআই পেয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা জিডিপির প্রায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। ওই বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা পেয়েছে ৮৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ২০ শতাংশ। দেশ দুটি মূলত এফডিআই সুরক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করেছে। মালদ্বীপ যেমন পর্যটন খাতে মনোযোগ দিয়েছে, শ্রীলঙ্কাও কৃষি, পর্যটন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের নীতিগত ও পরিচালনগত দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে অনেক বিকল্প থাকায় তারা পছন্দমতো দেশ নির্বাচন করতে পারে। যেসব দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ, পুঁজি আনয়ন ও প্রত্যাবর্তন সহজ, সুদের হার ও বিনিময় হার যৌক্তিক, দক্ষ শ্রমিক সহজলভ্য এবং সুযোগ-সুবিধা বেশি, সেসব দেশ তারা বেছে নেয়।
আশির দশক-পরবর্তী ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিকাশ লাভ করে। সে সময় দেশগুলো উৎপাদন খাতে এফডিআই আকর্ষণ করতে পেরেছিল। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলেও রয়েছে এফডিআই। দেশটিতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশে ১৮৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে। তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে এফডিআই এসেছিল ২১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। হিসাবে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ কম। এই পাঁচ মাসে আগের বছরের তুলনায় নিট এফডিআই কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ।
কারণ হিসেবে ব্যবসা সহজীকরণে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাবকে বিবেচনা করা যায়। আবার ডলার–সংকট, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা ও জ্বালানিসংকটের মতো বিষয় তো রয়েছেই।
ইতিমধ্যে এসঅ্যান্ডপি, মুডিস ও ফিচ রেটিংয়ে আমাদের ঋণমানের অবনমন হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি পেতে দেরি কিংবা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, জমির ইজারা পাওয়ার সমস্যা ও বন্দরে শুল্ক জটিলতার মতো অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পরিবহন, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, বিনিয়োগবান্ধব করনীতি ও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জও প্রকট।
বাংলাদেশে যোগাযোগ খাতে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিজনেস হাব হিসেবে বাংলাদেশ বিবেচিত হওয়ার কথাও শোনা গেছে। এ সুযোগকে এগিয়ে নিতে হলে বিদেশিদের জন্য ব্যবসা সহজ করায় বাংলাদেশকে বিনিয়োগবান্ধব নীতিনির্ধারণ করতে হবে।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারীদের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও ইউটিলিটি সার্ভিসের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে
হবে। বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা প্রদান এবং বিভিন্ন সেবার জন্য ননস্টপ সার্ভিসও চালু রাখতে হবে। তবে এখনো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় সেখানে আশানুরূপ বিনিয়োগ মিলছে না।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগে বস্ত্র খাত, টেলিকমিউনিকেশন, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কেমিক্যাল ও ওষুধ, নির্মাণ ও সার খাতে এগিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, চীন, নেদারল্যান্ডস, হংকং, নরওয়ে, ভারত, মালয়েশিয়া ও জাপান থেকে। প্রয়োজনীয় কিছু আইনি, আর্থিক ও নীতিগত ব্যবস্থা সংস্কার করা গেলে এসব খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে।
বিদ্যমান ব্যবসার পাশাপাশি আমাদের নতুন নতুন বাজার ধরতে হবে। শুধু বস্ত্র খাতে ইউরোপের ওপর ভর করে থাকলে চলবে না। সুযোগ দিতে হবে যেসব দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের। সেমিকন্ডাক্টর, ব্লু ইকোনমি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশে স্যামসাংসহ ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই খাতে বিনিয়োগ হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক মোবাইল সেট উৎপাদন সক্ষমতা তিন কোটির ওপরে। এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য যদি রপ্তানিমুখী করা যায়, তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কর্মসংস্থানও বাড়বে।
প্রতিবেশী ভারত ও চীন গাড়ির বাজার ধরেছে। আমাদেরও এসব বাজার তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। দেশের প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা বিপুল। প্লাস্টিকের খেলনা, জুতা ও গাড়ির টিউবের বাজার ধরলেও লাভ হবে।
নতুন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যারা ইতিমধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে, তাদের দেখভাল করা। এফডিআই আকর্ষণে সরকারকে ন্যূনতম সম্মানজনক সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায়ও জোর দিতে হবে।
বিনিয়োগবান্ধব করনীতি, সহযোগী আইনি পরিবেশ, দ্রুত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন হ্রাস, নীতি ধারাবাহিকতা, ইউটিলিটি ও বিনিয়োগ সেবার দিকে একযোগে নজর দিলে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা হয়তো দেখা যাবে। একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সুনাম নেই। বিনিয়োগ আকর্ষণে ৩০ পৃষ্ঠার একটি প্রসপেক্টাস বা ইনফরমেশন মেমোরেন্ডামে প্রায় ২৫ পৃষ্ঠা ধরে বলতে হয় কেন লোকেরা বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে বা করা উচিত। আর ৫ পৃষ্ঠায় বলা হয় কোথায়, কোন খাতে এবং কীভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। তাই দেশ মেরামত আর দুর্নীতির চিত্রটিও বারবার আলোচনায় আসবে বৈকি।
●মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক