জো বাইডেনের লেখা

পুতিন ও হামাস প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চায়

‘আমি ৭ অক্টোবরের পরপরই ইসরায়েল সফরে গিয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেটিই ছিল প্রথম ইসরায়েল সফর। আমি ইসরায়েলের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি।’
‘আমি ৭ অক্টোবরের পরপরই ইসরায়েল সফরে গিয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেটিই ছিল প্রথম ইসরায়েল সফর। আমি ইসরায়েলের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি।’

এ সময় আমরা যে বিকল্প বেছে নেব, তার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। এই যুদ্ধবিগ্রহের উল্টো দিকের বিশ্ব আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমরা কি হামাসের নির্ভেজাল শয়তানি দেখতে থাকব? ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—এই দুই জাতি কি একদিন পাশাপাশি দুটি দেশে শান্তিতে বাস করবে না?

আমরা কি ভ্লাদিমির পুতিনকে তাঁর আগ্রাসী ভূমিকার জন্য জবাবদিহি করব না? আমরা কি চাইব না যে ইউক্রেনের মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচুক? আর ইউরোপ নোঙর হয়েই থাকুক বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার?

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমরা কি একটা ইতিবাচক ভবিষ্যতের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব না? নাকি যারা আমাদের মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়, তাদের হাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেব? আমরা কি চাইব যে তারা টেনেহিঁচড়ে পৃথিবীকে আরও বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাক? আরও বিভক্তি তৈরি করুক?

পুতিন ও হামাস প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে যুদ্ধে জড়িয়েছে। পুতিন ও হামাসের আশা বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও একত্রকরণের চেষ্টাকে ধসিয়ে দেওয়া। তারা অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তো তা করতে দেবে না, দিতে পারে না। আমাদের নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং গোটা দুনিয়ার ভালোর জন্যই এই অবস্থান।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র একটি অপরিহার্য দেশ। আমরা মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক করি তাদের সঙ্গে, যারা দখলদারদের বিরুদ্ধে এক জোট হয়। আমাদের উদ্দেশ্য একটি উজ্জ্বলতর, শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা। পৃথিবী সমসাময়িক এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নেতৃত্বের দায় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ, আমরা যদি আজ এই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে দ্বন্দ্ব–সংঘাত আরও বাড়বে। আর পাল্লা দিয়ে বাড়বে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ব্যয়। আমরা তা হতে দিতে পারি না।

ইউক্রেনের মানুষের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করার মূলে কাজ করেছে এই বোধ। আমরা চেয়েছি, ইউক্রেন যেন পুতিনের বর্বর যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে যেতে পারেন। গত শতাব্দীর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ থেকে আমরা জেনেছি, ইউরোপে দখলদারির বিরুদ্ধে সবাই যদি চুপ থাকে, তাহলে সংকট বাড়ে। এই সংকট শুধু ইউরোপে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রকেও সক্রিয় হতে হয়। সে কারণে ইউক্রেনকে আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগ। ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিরোধ মেটাতে ইউক্রেনে আমাদের এই যুক্ততা প্রয়োজন।

আমরা মার্কিন সেনাবাহিনীকে এই যুদ্ধ থেকে দূরে রেখেছি। আমরা ইউক্রেনের সাহসী জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র ও আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছি যেন তারা তাদের দেশের মাটিকে মুক্ত রাখতে পারে।  আমরা চাই, এই বিরোধ যেন আর না ছড়ায়। পুতিনের এই জয়কে আমরা তাই প্রতিরোধ করতে চাই।

যুক্তরাষ্ট্র একা এসব কাজ করছে না। ৫০টির বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি যেন ইউক্রেন নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের অংশীদারেরা এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক দায়ের বড় অংশ বহন করছে। আমরা আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ন্যাটো গঠন করেছি। আমাদের মিত্রদের শক্তিসামর্থ্য বাড়লে আদতে আমাদেরই নিরাপত্তা জোরদার হবে। একই সঙ্গে এ কথাও জোরালোভাবে বলতে চাই যে রাশিয়ার আগ্রাসন রুখতে আমরা ন্যাটোর প্রতিটি ইঞ্চির সুরক্ষা দেব। এই যুদ্ধে এশিয়ায় আমাদের মিত্ররাও আমাদের সঙ্গে রয়েছে। তারাও ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছে এবং পুতিনের কাছ থেকে জবাবদিহি চাইছে। কারণ, তারা জানে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ইউরোপের স্থিতিশীলতা একই সূত্রে গাঁথা।

হাসামের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। বিমান ও স্থল অভিযান চালিয়ে গাজার একাংশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছ।

আমরা আরও দেখেছি কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধ পুরো বিশ্বে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়।
আমরা হামাসের খুনে ধ্বংসবাদী আচরণ থেকে ইসরায়েলিদের সুরক্ষার অধিকারের প্রতি জোরালো সমর্থন জানাই। ৭ অক্টোবর হামাস ৩৫ জন মার্কিন নাগরিকসহ ১ হাজার ২০০ মানুষকে খুন করে। হলোকাস্টের পর এক দিনে ইহুদিদের এত মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটেনি। নবজাতক, দু-আড়াই বছরের শিশু, মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, শারীরিক প্রতিবন্ধী, হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের অঙ্গহানি ও হত্যা করেছে ওরা। পরিবারের সব সদস্য খুন হয়েছেন, এমন নজিরও আছে।

কনসার্টে অংশগ্রহণকারী অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীরা খুন হয়েছেন। বুলেটবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ কিছু লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। আর এক মাসের বেশি সময় ধরে দুই শতাধিক মানুষ জিম্মি হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে শিশু ও মার্কিন নাগরিক রয়েছেন। তাঁদের পরিবারগুলো নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে। স্বজনেরা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, জানতে উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছে তারা। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখনো জিম্মি মুক্তির জন্য আমার সহকর্মীরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ইসরায়েলিরা যখন এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না, তখন আরও ৭ অক্টোবর ঘটানোর অঙ্গীকার করেছে হামাস। ঘোষণা দিয়েছে, তারা থামবে না। ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব ভূমি ও হামাসমুক্ত ভবিষ্যতের দাবিদার। গাজায় শিশুসহ কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিকের লাশের ছবি দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। ফিলিস্তিনি শিশুরা তাদের মৃত মা–বাবার জন্য কাঁদছে। বাবা-মায়েরাও তাঁদের সন্তানদের হাত-পায়ে নাম লিখে রাখছেন যেন ভয়ংকর কিছু ঘটে গেলে তাদের শনাক্ত করা যায়।

প্রতিটি প্রাণই অমূল্য। ফিলিস্তিনি নার্স ও চিকিৎসকেরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন প্রত্যেকের জীবনকে রক্ষা করতে। তাঁদের হাতে সামান্য সরঞ্জাম আছে, কিংবা কিছুই নেই। প্রত্যেক ফিলিস্তিনির প্রাণহানি একটি গোটা পরিবার বা সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

যুদ্ধে সাময়িক বিরতিই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া অনুচিত। যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত সারা জীবনের জন্য। উচিত চলমান সহিংসতার চক্র ভেঙে গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কিছু গড়ার উদ্যোগ নেওয়া, যেন একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয়।

৭ অক্টোবরের কয়েক সপ্তাহ আগে আমি নিউইয়র্কে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ওই আলোচনায় কিছু বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি নিয়ে কথা হয়। বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করতে পারে, এমন সব বিষয়ই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, জর্ডান ও  ইসরায়েলকে মাঝখানে রেখে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনের অভিনব প্রস্তাবও সে কারণেই উঠেছিল। গত সেপ্টেম্বরে ভারতে জি-২০ বৈঠকে এর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল।

দেশে দেশে যোগাযোগ বাজারের সম্ভাবনা বাড়ায়, বিনিয়োগেরও সুযোগ সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক যোগাযোগ–অর্থনৈতিক অবকাঠামো তরুণদের জন্য আরও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে তা-ই চাই। আমি এমন এক ভবিষ্যৎ চাই, যেখানে হামাসের সহিংসতা ও ঘৃণার কোনো জায়গা নেই। আমি মনে করি, এমন একটা ভবিষ্যৎ নস্যাৎ করতেই হামাস এই সংকট তৈরি করেছে।

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের বড় একটি অংশ শিশু। এক শিশুর মৃতদেহ জড়িয়ে কাঁদছেন স্বজন।

এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুটি পৃথক দেশের দিকে যেতে হবেই। যদিও এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই চাওয়া সুদূর পরাহত, তবু এটা হতেই হবে।

দুই দেশভিত্তিক সমাধান—দুটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করবে, সমান স্বাধীনতা, সুযোগ ও মর্যাদা ভোগ করবে, যেখানে শান্তিই থাকবে সর্বাগ্রে। এর জন্য ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি—দুই পক্ষের কাছ থেকেই প্রতিশ্রুতি চাই। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের মিত্র ও অংশীদারদের। এই কাজ এখনই শুরু করতে হবে।

এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সংকট উত্তরণের কিছু মৌলিক নীতি উপস্থাপন করতে চায়, যাকে ভিত্তি ধরে বিশ্বসম্প্রদায় নতুন করে পুনর্গঠনের দিকে যেতে পারে।

শুরুতেই বলতে চাই, গাজাকে আর কখনো সন্ত্রাসের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেওয়া যাবে না। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত, পুনর্দখল, ঘিরে রাখা, অবরোধ ও এলাকার পুনর্বিন্যাস করা যাবে না। এই যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনিদের দাবি ও তাদের যে স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষা, তা-ই ঠিক করে দেবে গাজার শাসনব্যবস্থাকে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে গাজা ও পশ্চিম তীরকে একক শাসনব্যবস্থার অধীনে আনা উচিত। আমরা সবাই যখন দুই রাষ্ট্র গঠনের কাজে নিয়োজিত থাকব, তখন পুনরুজ্জীবিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে।

আমি পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ব্যাপারে ইসরায়েলি নেতাদের কাছে আমার কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছি। আমি বলেছি, এই সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং এর সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পশ্চিম তীরে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলাকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত আছে।

চলমান সংকট শেষ হলেই গাজাবাসীর সমর্থনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা উচিত। অন্তর্বর্তীকালীন নিরাপত্তাব্যবস্থা জারি করা ও গাজা পুনর্গঠনের কাজে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। গাজা কিংবা পশ্চিম তীরে যেন সন্ত্রাসবাদের উত্থান না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা যদি প্রাথমিক এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার ব্যাপারে একমত হই, তাহলে আমরা একটা অন্য রকম ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করতে পারি। সামনের দিনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ, সমন্বিত ও সমৃদ্ধশালী মধ্যপ্রাচ্য গড়তে আরও সচেষ্ট হবে, যেখানে ৭ অক্টোবরের মতো কিছু আর কখনো ঘটবে না।

এর মধ্যে আমরা চেষ্টা করব এই সংঘাত যেন অন্যদিকে না ছড়ায়, তা নিশ্চিত করতে। আমি পরিস্থিতিকে শান্ত রাখতে দুটি মার্কিন রণতরি পাঠিয়েছি। আমরা হামাসকে ও যারা তাদের অর্থায়ন করে, তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখব। হামাসের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দিতে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা দেব এবং তারা যেন কোনো জায়গা থেকে এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেও কোনো অর্থ না পায়, সেই ব্যবস্থা করব।

আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাসদস্যদের নিরাপত্তায় যা করা প্রয়োজন, তার সবটাই আমরা করব এবং জানিয়ে রাখতে চাই, যারা এর মধ্যে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের সমুচিত জবাব দেওয়া হয়েছে।

আমি ৭ অক্টোবরের পরপরই ইসরায়েল সফরে গিয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেটিই ছিল প্রথম ইসরায়েল সফর। আমি ইসরায়েলের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি। তাদের জানাই, ইসরায়েলের সুখে-দুঃখে যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে। ইসরায়েলের নিজেকে সুরক্ষিত করার অধিকার আছে। কিন্তু তেল আবিবে আমি ইসরায়েলিদের বলেছিলাম, ক্ষোভ-শোক যেন তাদের বিভ্রান্ত না করে। বিভ্রান্তি থেকে ভুল হয় এবং আমরাও অতীতে এই ভুল করেছি।

শুরু থেকেই মার্কিন প্রশাসন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা বলেছে। নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় সব ধরনের ত্রাণসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খাবার, পানি ও ওষুধের মজুত দ্রুত কমে আসে।

ইসরায়েলে আমার সফরের অংশ হিসেবে আমি ইসরায়েল ও মিসরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি যেন জীবন বাঁচাতে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ শুরু করা যায়। কিছুদিনের মধ্যেই গাজায় ত্রাণ সরবরাহ পৌঁছাতে শুরু করে। এখন প্রতিদিন মিসর থেকে গাজায় ১০০ ট্রাক ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো হচ্ছে। আমরা এই সহায়তার পরিমাণ কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানোর চেষ্টা করেছি।

আমি মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির জন্য ওকালতি করছি, যেন বেসামরিক নাগরিকেরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যেতে পারে, যেন ত্রাণসহায়তা যাঁদের বেশি প্রয়োজন, তাঁদের কাছে পৌঁছানো যায়। ইসরায়েল আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মানবিক কারণে দুটি করিডর খুলে দিয়েছে এবং উত্তর গাজায় প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে যুদ্ধবিরতি দিচ্ছে। ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকেরা যেন দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় চলে যেতে পারেন।

এসব পদক্ষেপ হামাসের সন্ত্রাসবাদী কৌশলের বিপরীত। কারণ, তারা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে মিশে আছে। তারা শিশু ও নিরপরাধ মানুষকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ও আবাসিক ভবনের নিচে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু ও সর্বোচ্চ ভোগান্তি নিশ্চিত করা। হামাস যদি ফিলিস্তিনিদের জীবনের মায়া করত, তাহলে জিম্মিদের মুক্তি দিত, অস্ত্র ফেলে তাদের নেতারা আত্মসমর্পণ করতেন। যাঁরা ৭ অক্টোবর ঘটিয়েছেন, তাঁরাও থাকতেন আত্মসমর্পণকারীদের দলে।

হামাস যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই ধ্বংসবাদী মতবাদ আঁকড়ে ধরে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি শান্তি আনতে পারবে না। হামাস সদস্যদের জন্য যুদ্ধবিরতি মানে রকেটের আরও মজুত বাড়ানো, তাদের যোদ্ধাদের অবস্থানের পুনর্বিন্যাস করা ও নতুন করে নিরপরাধ মানুষের ওপর ধ্বংস ও হামলা চালানো। হামাসের হাতে আবারও গাজাকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ ফিলিস্তিনিদের নতুন জীবন গড়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা।

আর এখন এই ভয় ও সন্দেহের কালে, যখন রাগ-ক্ষোভের তীব্রতা অত্যন্ত বেশি, তখন আমাদের মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ন রাখতে কঠোর চেষ্টা করে যেতে হবে। আমাদের দেশে প্রত্যেকের যাঁর যাঁর ধর্ম পালনের, মতপ্রকাশের অধিকার আছে। আমাদের প্রত্যেকের অধিকার আছে বিতর্ক ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের। তবে স্কুল, কর্মক্ষেত্র কিংবা পাড়া–মহল্লায় কেউ যেন নিশানা না হন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রে ঘৃণার পালে হাওয়া লেগেছে অনেক, বর্ণবৈষম্য বেড়েছে, ইহুদিবিদ্বেষ বেড়েছ বহুগুণ। এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে ৭ অক্টোবরের পর। ইহুদি পরিবারগুলো তাদের ধর্মীয় পরিচয়বাহী কোনো চিহ্ন ধারণ করা বা তাদের জীবনযাপনের রীতির কারণে বিপদের মুখোমুখি হতে পারে, এমন ভয় পাচ্ছে। একই সঙ্গে মুসলিম আমেরিকান, ফিলিস্তিনি আমেরিকানসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ও অত্যাচারিত হচ্ছে এবং কষ্ট পাচ্ছে। তারা মনে করছে, ৯/১১–এর পর আমরা যে ইসলামভীতির আর অবিশ্বাসের উত্থান দেখেছিলাম, তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

ঘৃণা যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আমরা তখন চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। আমাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইহুদিবিদ্বেষ, ইসলামভীতি ও ঘৃণা ও পক্ষপাতিত্বের আরও যে ধরন আছে, তার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে। আমাদের অবশ্যই যেকোনো ধরনের সহিংসতা ও তিক্ত সমালোচনা পরিত্যাগ করতে হবে। পরস্পরকে শত্রু হিসেবে নয়, বরং একে-অন্যকে একজন আমেরিকান হিসেবে গণ্য করতে হবে।

ইউক্রেন, ইসরায়েল, গাজাসহ অন্য অনেক জায়গায় এত এত সহিংসতা ও যন্ত্রণার মুহূর্তে ভিন্ন রকম কিছু ভাবার সুযোগ কম। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নিয়েছি বারবার, তা ভুলে গেলে চলবে না। ধ্বংস, মৃত্যু, ক্ষয়, অভ্যুত্থান থেকেই বড় অগ্রগতির সূচনা হয়—আরও বেশি আশা—আরও বেশি স্বাধীনতা—আরও কম ক্ষোভ—আরও কম শোক—আরও কম যুদ্ধ।

এই লক্ষ্য পূরণের যে সংকল্প, তা থেকে আমরা বিচ্যুত হব না। কারণ এখনই সময়, কারণ আমরা আগের চেয়ে বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আমাদের মধ্যে পরিকল্পনাও আগের চেয়ে বৃহৎ এবং এই মুহূর্তে যে রাজনৈতিক সাহস প্রয়োজন, তা–ও বেশি। এটাই এখন সবচেয়ে প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বেই আমার প্রশাসন এই কৌশল নিয়েই এগোবে। এই উদ্দেশ্য পূরণে নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। এই পদক্ষেপ পৃথিবীকে আরও নিরাপদ করবে, আর যুক্তরাষ্ট্রকে করবে সুরক্ষিত।

  • জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট

    লেখাটি ‘দ্য ইউএস ওন্ট ব্যাক ডাউন ফ্রম দ্য চ্যালেঞ্চ অব পুতিন অ্যান্ড হামাস’ শিরোনামে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে ছাপা হয় ১৮ নভেম্বর। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম