অপ্রস্তুত সময়ে স্বপ্নময় কারিকুলামের অভিযাত্রা

এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জ্ঞানমূলক শিক্ষা রেখে জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশও সেই পথে পা বাড়িয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ২০২৩ সালে নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘জীবন দক্ষতাভিত্তিক’ এই শিক্ষাপদ্ধতির সূচনা হয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

অনেকেই বিরোধিতা করছেন। যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁরা কারা, কেন তাঁরা বিরোধিতা করছেন? তাঁরা কি সবাই এই কারিকুলামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন?

ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার সন্তান সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকায় এবং আমার বিবেচনায় এটি অসাধারণ একটি কারিকুলাম। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন পাঠায়, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা জরুরি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পাঠানো হয় তো সন্তান শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে, তার মধ্যে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, সে মানবিক ও সামষ্টিক চিন্তায় বেড়ে উঠবে। পাঠানো হয় নিজের সমৃদ্ধির পাশাপাশি তারা জাতি ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। সর্বোপরি একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে, সে রকম প্রত্যাশা থেকে।

যদি তা-ই হয়, তাহলে বলব চলমান কারিকুলামের চেয়ে নতুন যে কারিকুলাম ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা বহুগুণে এগিয়ে। কারণ, শুধু উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেই ভালো মানুষ হওয়া যায় না। ভালো মানুষ হতে হলে নিজের বিবেককে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হয়। নতুন কারিকুলাম সে ধরনের অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা শিশুশ্রেণির দিকে প্রথমে লিখতে শেখে, তারপর পড়া মুখস্থ করে। ওপরের শ্রেণিতে এসে প্রথমে পড়া মুখস্থ করে তারপর লেখে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাত্র দুটি জানালা খোলা আছে। কিন্তু নতুন যে শিক্ষাপদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি তার মধ্যে বলা, শোনা, দেখা এবং করার অভ্যাস গড়ে তুলতে আরও কয়েকটি জানালা সংযুক্ত করা হয়েছে। যে জানালা দিয়ে সে প্রকৃতি দেখবে, স্মৃতিসৌধ দেখবে, মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনসমূহ দেখবে, গল্প শুনবে এবং সে সম্পর্কে লিখবে ও বলবে। যা তাকে আরও সৃজনশীল করে তুলবে, আরও বেশি জীবন ঘনিষ্ঠ করে তুলবে।

তাহলে এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমস্যাটা কোথায়, কেন বিরোধিতা হচ্ছে এবং কারা করছে?

প্রথমত, একটি পদ্ধতি থেকে আরেকটি পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করতে হলে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা নেওয়া হয়নি। বুনিয়াদ বা ভিত্তি প্রস্তুত করার জন্য কোনো অনুশীলন করা হয়নি। যেসব শিক্ষক শিশুদের পাঠদান করবেন, তাঁদেরই এই কারিকুলামে পাঠদানের জন্য আগে থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত বা উপযুক্ত করে তোলা হয়নি।

এমন একটি বাস্তবতায় যখন হঠাৎ করে একটি শিক্ষাক্রম তাঁদের হাতে এসেছে, তখন তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। তাঁরা একধরনের অস্বস্তিতে ভুগছেন। অন্যদিকে একশ্রেণির শিক্ষক আছেন, যাঁরা টিউশনি করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করেন। এই শিক্ষাব্যবস্থা যদি পুরোপুরি চালু হয়ে যায়, তাহলে তাঁদের সে পথ বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হবে গাইড ব্যবসায়ীদের ব্যবসা। যে কারণে তাঁদের দিক থেকেও একটা বাধা ও অপপ্রচার চলছে।

দ্বিতীয়ত, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো এবং উপকরণগত যে সক্ষমতা দরকার, বিদ্যালয়কে সেভাবে উন্নীত করা হয়নি। যে কারণে নতুন কারিকুলাম চালু করতে যে আর্থিক ব্যয় বেড়েছে, তা গিয়ে পড়ছে অভিভাবকের ঘাড়ে।

অভিভাবকদের অনেককেই তাঁর সন্তানের প্রতিদিনের উপকরণ সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেও তাঁদের কাছে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। সুতরাং তিনি যখন দেখছেন তার সন্তান আগের মতো বই-খাতা নিয়ে টেবিলে দীর্ঘক্ষণ থাকছে না, সে নানা ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরিতে ঘোরাঘুরি করছে, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, অতিমাত্রায় ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করছে, তখন তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে একধরনের সংশয় ও আতঙ্ক কাজ করছে।

তৃতীয়ত, আমাদের অনেক পরিবারের সন্তানেরা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। একটা বড় সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তার পরিবার থেকে প্রথম লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সুতরাং নতুন কারিকুলামের পাঠোদ্ধারে পরিবারের কারওর সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে সে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের কাছ থেকে সম্যক ধারণা পাচ্ছে না, পরিবারের কারওর সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছে না, তখন সে কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। আবার তার জন্য প্রযুক্তিগত পর্যাপ্ততা ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের ছাত্রছাত্রীরা এ ব্যাপারে অসহায় হয়ে পড়ছে। এ কারণে তাদের মধ্যেও এ কারিকুলামের প্রতি একধরনের অনীহা রয়েছে।

চতুর্থত, একটা বড় ধরনের বাধা আসছে রক্ষণশীলদের মধ্য থেকে। কারণ, এই কারিকুলামে সংগীত, অভিনয়, ছবি আঁকাসহ সৃজনশীল কর্মকাণ্ড যুক্ত রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সে যুক্তিবাদী হয়ে উঠবে, মানবিক বোধে সমৃদ্ধ হবে এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখবে। তাকে ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে আলাদা করবে না। যা তাঁরা কোনোভাবেই চান না। সুতরাং তাঁরা এসব বিষয় শিক্ষাক্রমে রাখতে দিতে চান না।

পঞ্চমত, যাঁরা সন্তানকে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান, তাঁদের দিক থেকেও একধরনের প্রতিবাদ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শিক্ষা কমানো হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা নবম-দশম শ্রেণি থেকেই জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতো। এখন তাকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে যুক্ত হতে হবে। অভিভাবকেরা সংশয়ে পড়েছেন যে তাঁদের সন্তান কি হঠাৎ করে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে নিজেকে উচ্চতর পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত করতে পারবে?

এ সংশয় থেকে বের হওয়ার জন্য যাঁরা সন্তানকে আরও বেশি বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান, তাঁদের জন্য ঐচ্ছিক হিসেবে অঙ্ক ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিষয়গুলো যুক্ত করা যেতে পারে। যদিও কয়েকটি বই যুক্ত করলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, ব্যাপারটা সে রকম নয়। শিক্ষাপদ্ধতি কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলবে, সেটিই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত।

এ রকম একটা অবস্থায় স্বপ্নময় এই কারিকুলামের যাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে। এই শিক্ষাক্রমকে যদি অগ্রসর করে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সংবেদনশীল করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

সামর্থ্যহীন শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ছিটকে না পড়ে, তার জন্য প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি যে বিভ্রান্তিগুলো ছড়ানো হচ্ছে, তা দূর করতে নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং কোচিং ব্যবসায়ী, গাইড বই বিক্রেতাদের বিরোধিতা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করা।

  • অমিত রঞ্জন দে সাধারণ সম্পাদক, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী