মতামত

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই পক্ষের সঙ্গে যেভাবে খেলছেন এরদোয়ান

পুতিন ও এরদোয়ান– বন্ধুও নয়, সত্যও নয়
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ তুরস্ককে ভূরাজনৈতিক পাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছে। ন্যাটোর প্রথম দিককার সদস্যরাষ্ট্র তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এটিকে তুরস্ক নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতে এবং নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধিতে ব্যবহার করে। ইতিমধ্যে সিরিয়ায় একটা বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক। এ অভিযান রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সামরিক উত্তেজনা বাড়বে কি না, জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

অক্টোবরের শেষ দিকে সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দিদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তুরস্ক। সিরিয়ার কুর্দি–অধ্যুষিত অঞ্চলে তুরস্ক ভূমি দখল করবে কি না, সে হুমকিও এখন তৈরি হয়েছে। সিরিয়া সরকারের প্রধান মিত্র রাশিয়া, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কুর্দিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

সিরিয়ায় চলমান সংঘাতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তারা এ ঘটনায় খুব সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার কুর্দিদের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতা করছে রাশিয়া। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে যে তুরস্কের সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য স্থল অভিযান আইএসআইএস–বিরোধী অভিযানে বাধা সৃষ্টি করবে।

ঐতিহাসিকভাবে তুরস্ক পশ্চিম ও রাশিয়া—দুই পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বাস্তবতায় আঙ্কারা কি সেই ভূমিকা বজায় রাখতে পারবে?

১০০ বছর ধরে পশ্চিম ও রাশিয়া—দুই পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ককে তুরস্ক তার অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক অথবা সামাজিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহার করে আসছে। ২০২২ সালে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছেন। এ কাজে তুরস্ক কেন যোগ্য, তার নজির ইতিহাস থেকেই মেলে।

এরদোয়ানকে এখন কঠিন এক ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখতে হচ্ছে। সদস্যদেশ হিসেবে ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা মানতে হচ্ছে, একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করতে হচ্ছে। রাশিয়ান ও আমেরিকানদের মধ্যে কূটনৈতিক কিংবা পর্দার অন্তরালের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরদোয়ান এখন একমাত্র নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব

১৯২১ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা রাশিয়ার বলশেভিকদের সঙ্গে মস্কোয় ‘বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব’ চুক্তি সই করে। রাশিয়ান নেতা লেনিন ও তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা কামাল আতাতুর্ক—দুজনেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ক্ষেত্রে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।

এ চুক্তি যখন স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সে সময়ে আনাতোলিয়ায় গ্রিকদের সঙ্গে তুর্কিদের যুদ্ধ চলছিল; একই সময়ে রাশিয়ানদের গৃহযুদ্ধও চলছিল। লেনিন বলেছিলেন, ‘তুরস্ক একাই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে এমন শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলবে যে তারা দেশটি থেকে হাত গোটাতে বাধ্য হবে।’

আতাতুর্কও এ চুক্তিকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বলে মনে করতেন। ইতিহাসবিদ সাম হির্স্ট এ ঘটনাকে ‘আন্তদেশীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেন। সোভিয়েত রাশিয়া বৈশ্বিক উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ে তাদের সমর্থন দেওয়ার যে অঙ্গীকার করেছিল, তার বাস্তবায়ন বলেও মনে করেন তিনি। তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা সে সময় রাশিয়ার নতুন সরকারের কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে বস্তুগত সহযোগিতা পেয়েছিল।

১৯২৩ সালে তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের মোড় ঘুরে যেতে থাকে। বৈশ্বিক উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের আগের প্রেক্ষাপট বদলে যায়। ব্যবসা ও বাণিজ্য–সম্পর্কিত ইস্যুতে তুরস্ক বাস্তববাদী অবস্থান গ্রহণ করে। অসন্তুষ্টি থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতের পর রাশিয়া আরও বেশি ভূখণ্ডের ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করে। আন্তর্জাতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ দার্দেনেলিস ও বসফরাস প্রণালির দাবিও তারা করে বসে। এ ঘটনায় নবগঠিত জোট ন্যাটোতে যুক্ত হয় তুরস্ক। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন দার্দেনেলিস প্রণালিতে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে ব্যাখ্যা দেন, তা বেশ বিখ্যাত হয়ে আছে। সেখানে ঘাঁটি স্থাপনে রাশিয়ার নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নটি তুলে তুরস্কের মতো দুর্বল ও অবন্ধুসুলভ রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন জোসেফ স্তালিন।

জি–২০ সম্মেলনের মাঝে বাইডেনের সঙ্গে এরদোয়ানের বৈঠক

এজিয়ান ও ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের এ দুই প্রণালি নিয়ে যুদ্ধ শুরু হবে কি না, সে শঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছিল। রাশিয়া শেষ পর্যন্ত সেখানকার স্থিতাবস্থা মেনে নেয়। একসময় স্তালিন–যুগের অবসান হয়। পরবর্তী দশকগুলোয় রাশিয়ার অবস্থান খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। কালক্রমে তুরস্কও সেই সঙ্গে গ্রিস শীতল যুদ্ধের অন্যতম সম্মুখসারির দেশ হয়ে ওঠে। সে সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় তুরস্ক।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসস্তূপের ওপর ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় নতুন এক তুরস্কের উত্থান ঘটে। বিবাদ থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে গতিশীল সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বন্ধনে যুক্ত হওয়ায় নীতি নেয় তুরস্ক।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৬—এ ৪ বছরে রাশিয়া ও তুরস্ক ১৫টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে। কৃষ্ণসাগর অঞ্চল দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। কয়লা ও ইস্পাত যেমন পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা এনে দিয়েছে, কৃষ্ণসাগর অঞ্চলেও তেমনি প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।

কুর্দি ইস্যু

এ সহস্রাব্দের প্রভাতকালে ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে ইরাকি কুর্দিরা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক তখন থেকেই জটিল রূপ নেয়। বিপরীতে বাণিজ্য, জ্বালানি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের অন্তর্ভুক্ত না করায় দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া ঘিরেই নিজেদের শক্তি সংহত করেছে।

পুতিন ও এরদোয়ান—দুজনেই পশ্চিমের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে কাজে লাগাচ্ছে; যদিও তাঁরা যে ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করেছেন, সেখানে হাতে গোনা অনুগত কয়েকজনই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতে পারেন।

তুরস্কের সীমান্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় একসময় প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্র পরিণত হয়। কুর্দি–অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবি উঠলে উত্তেজনা নতুন মোড় নেয়। এ যুদ্ধের কারণে তুরস্ককে শরণার্থীদের বিশাল বোঝা বইতে হচ্ছে।

এরদোয়ানকে এখন কঠিন এক ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখতে হচ্ছে। সদস্যদেশ হিসেবে ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা মানতে হচ্ছে, একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করতে হচ্ছে। রাশিয়ান ও আমেরিকানদের মধ্যে কূটনৈতিক কিংবা পর্দার অন্তরালের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরদোয়ান এখন একমাত্র নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এ খেলায় ঝুঁকি অনেক। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে এরদোয়ানের পক্ষে ভালো করা সম্ভব না–ও হতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এরদোয়ানের অবস্থান—এ দুই ইস্যুকে জনপ্রিয়তা তৈরির হাতিয়ার করতে পারেন তিনি।

  • জর্জ গিয়ানাকাপোলাস ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর হেলেনিক স্টাডিজ, কিংস কলেজ লন্ডন
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে