বীরের এ রক্তস্রোত

নতুন সূর্য যখন ওঠে, তখন তার রং লাল হয়। এ হলো নবজন্মের রক্তপাত। বিপ্লব বিষয়ে এসব কাব্যকথা বহুদিন শুনে এসেছি।

রংপুরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক শহীদ আবু সাঈদ যেভাবে বুকে বুলেট বরণ করে নিয়েছেন, যেভাবে একে একে গুলি এসে লাগার পরও তিনি সরছিলেন না, নড়ছিলেন না, তা বহুদিন বহু নিপীড়িত মানুষকে প্রতিবাদ করার সাহস জোগাবে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে মৃত্যুর আগে দেওয়া ফেসবুক পোস্ট:

‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যাঁরা ছিলেন, সবাই তো মরে গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। এই প্রজন্মে যাঁরা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যত দিন বেঁচে আছেন, মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান। রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। তাহলে প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।’
আবু সাঈদও বেঁচে থাকবেন, বহুদিন, বহুযুগ।

আবু সাঈদ

কিন্তু বিজয় অর্জিত হওয়ার পর যারা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে আগুন দিল, শিল্পী রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুন দিল, সারা বাংলাদেশে বহু বাড়িঘরে আগুন দিল, যারা পাঁচতারা হোটেলে আগুন দিয়ে বিদেশি অতিথিকে কয়লা বানাল, যারা ভাস্কর্য ভাঙছে, পাঠাগারে আগুন দিচ্ছে, তারা কার স্বার্থ উদ্ধার করতে নেমেছে? লুটপাটকারীরা চিরকালই ছিল, এই সুযোগে তারা ছোট ছোট দলে চাপাতি হাতে বেরিয়ে পড়েছে।

প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হাতে, তারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-কারখানায় হাজির হচ্ছে, চাঁদা দিন, তা না হলে আগুন দেব। এখানে বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্রের প্রশ্ন নেই। চাঁদা দাও, না হলে আগুন। আগে ছিল ছিন্নমূল হকার্স লিগ, এখন সেখানে হকার্স দলের সাইনবোর্ড। মাৎস্যন্যায়।

এ জন্যই গতকাল প্রথম আলো অনলাইনে লিখেছিলাম, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, তাড়াতাড়ি আসুন’।

দেশে সরকার দরকার, প্রশাসন দরকার, পুলিশ দরকার, আইনশৃঙ্খলা দরকার। যাঁরা আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে, ছাত্রলীগ–আওয়ামী লীগের অস্ত্রের আঘাতে শহীদ হয়েছেন, অন্ধ হয়েছেন, চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়েছেন, তাঁদের জন্য অশ্রুবন্যায় ভাসতে ভাসতে আমরা দেখছি, লুটতরাজ। হাঙ্গামাকারীদের আগুনে হামলায় আবারও শিশুরা মারা যাচ্ছে, হিন্দু বৌদ্ধ পরিবারগুলোয় কান্নার রোল। আওয়ামী দস্যু বা পুলিশ হিসেবে চিহ্নিত করে গাছে উল্টো করে ঝুলিয়ে কোপানো হচ্ছে। এসব তো বন্ধ করতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় ডাকাতির রব। কেউ আর ঘুমাতে পারছে না।

ড. ইউনূসের সরকারের প্রথম কাজ হবে তাই ল অ্যান্ড অর্ডার প্রতিষ্ঠা করা। আইন ও শৃঙ্খলা। বহু উৎসাহজনক খবর আছে। শিক্ষার্থীরা সড়কে শৃঙ্খলা আনছে, চাঁদাবাজ প্রতিহত করছে, বহু জায়গা পরিষ্কার ঝকঝকে করে ফেলেছে, রাতে পাহারা দিয়ে জনপদ পরিষ্কার করছে।

আশা করি, আজ থেকে কেবল শিক্ষার্থীরা রাস্তার ময়লা বা বিশৃঙ্খলা দূর করবে না, রাষ্ট্রের ময়লা, সমাজের ময়লা ও বিশৃঙ্খলা দূর করতেও অন্তর্বর্তী সরকারকে বাধ্য করবে। আমাদের নিজের মনের ফ্যাসিস্টকেও দমন করতে হবে। যে বলে, গতকাল যখন এই অপরাধ হচ্ছিল, তখন তো বলেননি, কাজেই আজ বলতে পারবেন না, সেও কিন্তু ফ্যাসিস্টের মতোই কথাটা বলে ফেলল।

প্রথম থেকেই সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। গণমাধ্যমগুলোকেও বাক্‌স্বাধীনতা প্রথম দিন থেকেই চর্চা করতে হবে। আজকে নয়, কালকে থেকে বলব বললেই শাসকেরা চেপে ধরবে।
আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের রায়: সংবাদমাধ্যম সেবা করবে শাসিতদের, শাসকদের নয়।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন ২২ শ্রাবণ নীরবে কেটে গেল। দুবছর আগে ৫ আগস্ট প্রথম আলোয় লিখেছিলাম:
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে;
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার,
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় এই ডাক দিয়ে গেছেন। অন্যায়কারী, জুলুমকারীরা মনের মধ্যে ঠিকই জানে, তারা অন্যায় করছে। কাজেই তারা ভীরু হয়। একবার মাথা তুলে একসঙ্গে তাদের সামনে দাঁড়াতে পারলেই হয়! তারা ধেয়ে পালিয়ে যায়।
আজকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে বলি:
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।
         স্বর্গ কি হবে না কেনা।
         বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না
             এত ঋণ?
    রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন।

রাতের তপস্যা যেন দিন আগে, স্বর্গ যেন এই বাংলাদেশে রচিত হয়, যেখানে সব ধর্মের মানুষ, সব বর্ণের মানুষ, সব ভাষার মানুষ, সব লিঙ্গের মানুষ যার যার জীবনাচরণ নিয়ে মিলেমিশে সুখেশান্তিতে থাকবে। যেখানে কেউ কারও মৌলিক অধিকারের ওপরে হস্তক্ষেপ করবে না। যেখানে রাষ্ট্র কারও টুঁটি চেপে ধরবে না, এক দল আরেক দলের মতের ওপরে চাপাতি বা অস্ত্র হাতে হামলে পড়বে না।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক